E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

বোয়ালমারীতে প্রশাসনের নিষেধ উপেক্ষা করে একাত্তরের গণকবরের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ

২০২২ আগস্ট ২১ ১৬:৪১:৫৬
বোয়ালমারীতে প্রশাসনের নিষেধ উপেক্ষা করে একাত্তরের গণকবরের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ

কাজী হাসান ফিরোজ, বোয়ালমারী : স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী যেতে না যেতেই ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে শহীদদের শেষ স্মৃতিচিহ্ন  পৌর শহরের সরকারি কলেজ রোডস্থ গণকবরের মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। প্রশাসন, স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ এবং কতিপয় মুক্তিযোদ্ধার নমনীয়তার সুযোগে বারবার মুক্তিযুদ্ধ কালীন শহীদদদের গণকবরের অবমাননা করছে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র।

গণকবরের উপর শৌচাগার সহ টিনের ঘর নির্মাণের পর এবার শুরু হয়েছে বহুতল ভবন নির্মাণ। গণকবরের জন্যে প্রস্তাবিত জায়গায় বহুতল ভবনের কাজ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দুই মাস বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়েছে। প্রশাসনের নিষেধ অমান্য করে কাজ চলমান রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক আব্দুর রশীদ। প্রথম দফায় প্রশাসনের দৃঢ় ভূমিকায় নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও দুইমাস পর প্রশাসনের নমনীয়তার কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলমান থাকার ফলে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের বীরত্বগাঁথার শেষ স্মৃতিচিহ্নও আজ হুমকির মুখে।

জানা যায়, '৭১এ স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি ও তাদের দোসর রাজাকার আল বদর বাহিনী কলেজ রোড সংলগ্ন নির্মাণাধীন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে টর্চার সেল বানিয়ে ছাত্রনেতা রেজাউলসহ শতাধিক মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করে সরকারি কলেজ সংলগ্ন ছনের ক্ষেতে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। প্রত্যক্ষ দর্শীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পাকিস্তানী আর্মিদের দোসররা স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের সুন্দরী মেয়ে ও বধূদের ধরে এনে পাকিস্তানি আর্মির হাতে তুলে দিত। টর্চার সেলে এনে বিনোদন শেষে তারা তাঁদেরকে হত্যা করে কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে পুঁতে রাখতো। প্রত্যক্ষ দর্শীরা জানান , আর্মিরা চলে যাবার পর কলেজ সংলগ্ন ছন ক্ষেতের বিভিন্ন জায়গায় শিয়াল- কুকুরে খাওয়া অর্ধগলিত লাশ দেখা গেছে। তাঁরা জানান বধ্যভূমির জন্যে প্রস্তাবিত জায়গা ছাড়াও ছন ক্ষেতের অন্যান্য জায়গায়ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ কবর দেয়া হয়েছে।

কয়েক বছর পূর্বে জনৈক জামায়াতে ইসলামীর নেতা বধ্যভূমির উপর মালিকানা শর্তে বসতবাড়ি নির্মাণ কালীন শহীদদের কঙ্কাল উঠে এলে বসতবাড়ির পাশেই তা পুনরায় সমাধিস্থ করেন স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ। পরবর্তীতে সেখানে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার, সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুর রহমানের উদ্যোগে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। সাবেক সংসদ সদস্যের পরামর্শে স্থানীয় প্রশাসন ২০২০ সালে পৌরসভার শিবপুর মৌজার ১২২৭ নং দাগের ৪৭ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে গণকবরটি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র স্থাপন করার লক্ষে এই জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠানো হয় । কিন্তু দুই বছর আগে প্রস্তাবনা পাঠানো হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

গণকবরটি যে জায়গায় অবস্থিত সেই স্থানের জমির মালিকানা ছিল বোয়ালমারী সরকারি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের ডেমোনেস্ট্রেটর মানিক শীলের । বধ্যভূমি হিসাবে অধিগ্রহণ হয়ে যেতে পারে এ কথা বলে আওয়ামীলীগ দলীয় কতিপয় ব্যক্তি নামমাত্র মূল্যে ওই জমির মালিকানা বদলের ব্যবস্থা করেন । স্থানীয় কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার তথাকথিত স্বপক্ষের নেতাদের সহযোগিতায় জমিটির বর্তমান মালিক উপজেলার রূপাপাত ইউনিয়নের কাটাগড় গ্রামের মো. খালিদ হাসান বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মুছে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।

বোয়ালমারী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক চন্দনা সম্পাদক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বোয়ালমারীতে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল, তার প্রমাণ কলেজ রোডস্থ এই গণকবর বা বধ্যভূমি। যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে এ গণকবরটি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। ইতোপূর্বে মূল গণকবরের উপর বসতবাড়ি, গণকবরের উপর শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে, যা লজ্জাজনক। বাড়ি নির্মানের সময় খননকাজে উঠে আসা শহীদদের হাড় কঙ্কাল যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় সমাধিস্থ করে গণকবরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে, সেখানে বহুতল ভবন নির্মানের ফলে সেটিরও সংকোচন হলে শহীদদের বীরত্ব গাঁথার ইতিহাস মুছে যাবে। এটা সংরক্ষণের জোর দাবি জানাই।

জমিটির মালিক উপজেলার রূপাপাত ইউনিয়নের কাটাগড় গ্রামের মো. খালিদ হাসান বলেন,ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে বাড়ি নির্মাণ কি অপরাধ? তিনি বলেন, আমার নির্মাণাধীন বাড়ির পূর্বপার্শ্বে মূল গণকবর বলে শুনেছি । সেখানে একজন বাড়ি করে বসে আছেন। পারলে সেটা উদ্ধার করে গণকবর হিসাবে সংরক্ষণ করুন।

এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক আব্দুর রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বধ্যভূমির স্থানে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের জন্য পুরো প্লট (৪৭ শতাংশ) অধিগ্রহণ করার জন্য ইউএনও কর্তৃক জেলা প্রশাসকের নিকট প্রস্তাব পাঠানো আছে। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে জনৈক ব্যক্তি বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। বিষয়টি এসিল্যান্ডকে জানিয়েছি। তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানি না।

বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানান, উপজেলা প্রশাসন থেকে দুই বছর আগে ভূমি অধিগ্রহণের জন্যে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিলো। যে প্রকল্পের অধীনে বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের কথা ছিলো, প্রস্তাবনা পাঠানোর পূর্বেই সে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয় প্রকল্পের অনুমোদন দেননি। তিনি আরো বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কোন প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা নেই। মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দেয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় কোন স্থাপনা নির্মাণে বাধা দেয়ার ক্ষমতা উপজেলা প্রশাসনের নেই।

ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরা পাকা বাড়ি নির্মাতাকে অনুরোধ করেছি। সে আমাদের অনুরোধে নির্মাণ কাজ দুই মাসাধিক কাল বন্ধ রেখেছেন। ইউএনও বলেন, বাড়ি নির্মাতা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের কথা রাখতে গিয়ে নির্মাণ সামগ্রির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

নির্বাহী অফিসার আরো বলেন, প্রকল্প পাস হলে স্থাপনার মালিকগণ স্থাপনা ভেঙে দিতে বাধ্য। প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে আমি বাধা দিলে উনারা আমার বিরুদ্ধে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তারপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে একাধিকবার বুঝিয়েছি। কিন্তু তারা শুনছেননা। আমি আবারও তাদের বুঝাতে পারি, এর বেশি কিছু করার বা কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।

(কেএফ/এসপি/আগস্ট ২১, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test