E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরায় ১৬ হামলাকারিকে গণপিটুনির পর পুলিশে সোপর্দ

২০২৪ জানুয়ারি ১৯ ০০:২৬:৩৯
সাতক্ষীরায় ১৬ হামলাকারিকে গণপিটুনির পর পুলিশে সোপর্দ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : পাওয়ারনামা মূলে কেনা সরকারি খাস জমি দখল করতে ভূমিহীনরা বৃহষ্পতিবার ভোর পৌনে চারটার দিকে  সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার ঢেপুখালিতে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এ সময় হামলাকারিরা মুহুমুহু চকলেট বাজি ছুঁড়লে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসি একত্রিত হয়ে গণধোলাইয়ের পর নারীসহ ১৬জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। ঘটনাস্থল থেকে ছয়টি রাম দা, দুটি হাঁসুয়া, চারটি গুলতি, একটি কুড়াল উদ্ধার করা হয়েছে।

আহতরা হলো, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার ভূমিহীন জনপদ কালাবাড়িয়া গ্রামের রুপচাঁদ গাজীর ছেলে রুহুল আমিন (৬০), তার স্ত্রী তানিয়া বেগম (৫০), তানিয়ার প্রথম পক্ষের প্রয়াত স্বামী শহীদুল ইসলামের ছেলে তানভির হোসেন সজীব (২০), একই গ্রামের ইছা শেখের ছেলে হোসেন আলী শেখ (৫৫), তার ছেলে রায়হান শেখ (২৫), রায়হানের স্ত্রী বৃষ্টি (২২), মাঝ পারুলিয়া গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে মোমিন হোসেন (২৩), দক্ষিণ পারুলিয়া দীঘির পাড়ের নূর ইসলামের ছেলে সজীব হোসেন (১৯), উত্তর সখীপুর গ্রামের নেছার আলীর ছেলে সজীব হোসেন (২১), একই গ্রামের আজাহারুল ইসলামের ছেলে তাজমির হোসেন, শফিকুল ইসলামের ছেলে সাকিব হোসেন, রবিউল ইসলামের ছেলে মারুফ হোসেন, ধোপাডাঙা গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে তৈয়বুর রহমান (২২), কালিগঞ্জ উপজেলার সোনাতলা গ্রামের মান্দার গাজীর ছেলে মুনসুর গাজী (৩৫), তার স্ত্রী ফিরোজা খাতুন (৩০), একই উপজেলার ইন্দ্রনগর গ্রামের আবুল হোসেনের স্ত্রী রোকেয়া খাতুন(৪৩)। আহতদের ১৩ জনকে প্রথমে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় নয়জনকে বিকেলে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সরেজমিনে বৃহষ্পতিবার বিকেলে দেবহাটা উপজেলার দক্ষিণ ঢেপুখালি গ্রামে যেয়ে দেখা গেছে, প্রয়াত ইমান আলীর বাড়ির বাইরের ফটকের দুটি তালা, ক্লোবসিগ্যাল ফটকের একটি তালা, চেয়ার, টেবিল, পানির ড্রামসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। প্রধান ফটকের ভিতরে তিন-চারটি চকলেট বাজি অবিষ্ফোরিত অবস্থায় পড়ে আছে। ইমান আলীর স্ত্রী সালেহা খাতুন ও তার দুই সন্তান ইমরুল কায়েস ও ইমরান রাজাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী সফেদ আলীর বাড়ির মধ্যে ফটকের তালা ভাঙা। ঘরের মধ্যে থাকা শোকেস, ফ্রিজ, চাউলের ড্রাম, বাক্সসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। ওই এলাকায় ছাদ বিশিষ্ঠ মোজাইক টাইলসের বাড়িও দেখা যায়।

জানতে চাইলে প্রয়াত ইমান আলীর শ্বাশুড়ি মনোয়ারা খাতুন জানান, তিন দিন আগে তিনি মেয়ের বাড়িতে এসেছেন। প্রায় এক বছর যাবৎ ভ‚মিহীনরা তার মেয়ের বাড়ি ও জমি দখল করবে মর্মে তিনি শুনে আসছিলেন। বুধবার বিকেলে পুলিশ এসে তাদেরকে রাতে দরজা খুলে বের না হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে রান্নাঘর, কাঠঘরসহ বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালায়। একপর্যায়ে ইমান আলীর ভাই আব্দুর রাজ্জাক যাতে বাড়িতে না আসে সেজন্য তাদেরকে সতর্ক করা হয়।

বৃহষ্পতিবার ভোর পৌনে চারটার দিকে কালাবাড়িয়ার ভ‚মিহীন রুহুল আমিন, তার স্ত্রী তানিয়া বেগম, তাদের ছেলে তানভির হোসেন সজীবসহ ৩৫/৪০ জন হাতে রাম দা, কুড়াল হাতে চকলেট বাজি ফোটাতে ফোটাতে জামাতার বাড়ির প্রধান ফটকের দরজার দুটি তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। পরে তারা ক্লোলাবসিগ্যাল গেটের একটি তালা, ভেঙে বারান্দার ওঠার পর ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে। এ সময় তারা বারান্দায় থাকা চেয়ার, টেবিল, পানির ড্রাম ভাঙচুর করে। চকলেট বাজির বিকট শব্দে এলাকার মানুষ বাড়ির আশে পাশে জড়ো হতে থাকে। খবর দেওয়া হয় ৯৯৯ এ।

আব্দুল মজিদের স্ত্রী নাসরিন খাতুন জানান, ইমান আলীর বাড়ির পর তাদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। তাদের বাড়ির দরজার তালা ভেঙে ঘরের মধ্যে ঢোকে হামলাকারিরা। তারা একে একে ঘরের মধ্যে থাকা টিভি, ফ্রিজ, টিনের বাক্স, চালের ড্রামসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়। বাধা দেওয়ায় তার শ্বাশুড়ি রোকেয়া বেগমকে(সফেদ আলী সরদারের স্ত্রী) এলোপাতাড়ি মারপিট করা হয়। পরে শ্বাশুড়িকে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

ঢেপুখালি পূর্বপাড়ার আবুল কালাম আজাদ জানান, সখীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সালামতুল্লাহ গাজী, কাজলা ইন্দ্রনগরের রহিম পাড়, করিম পাড়, নাংলা গ্রামের হারুন বিশ্বাস এবং দেবীশহর গ্রামের কিংকর স্বর্ণকারের মালিকানাধীন নওয়াপাড়া ইউনিয়নের রামনাথপুর মৌজার ৪৬১৭ দাগের ৯০ বিঘা জমি ১৯৯৭ সালে পাওয়ারনামা মূলে কিনে তাতে বসতি গড়ে তোলেন ১৩টি ভ‚মিহীন পরিবার। জমিটি একপর্যায়ে খাস খতিয়ানে অর্ন্তভুক্ত হলে মালিকপক্ষ আদালতে মামলা করায় জমি আর রেজিষ্ট্রি করে দিতে পারেননি মালিকপক্ষ।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিহীনদের হঠিয়ে জনবসতিপূর্ণ ওই গোটা জনপদ জবরদখলের হুমকি দিয়ে আসছিলেন কালাবাড়িয়া গ্রামের বর্তমান বাসিন্দা ও কালিগঞ্জের সন্ন্যাসীর চক গ্রামের মৃত রুপচাঁদ গাজীর ছেলে রুহুল আমীন গাজী, তার স্ত্রী তানিয়া বেগম । এ নিয়ে গেল কয়েক মাস ওই জনপদে আতঙ্ক ও উত্তেজনা কাজ করছিল।

আবুল কালাম আজাদ আরো জানান,বৃহষ্পতিবার ভোর পৌনে চারটার দিকে ভ‚মিদস্যু রুহুল আমিন, তার স্ত্রী তানিয়া বেগম ও ছেলে তানভির হোসেন সজীব দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অন্ততঃ ৩০/৪০ জনের বাহিনী নিয়ে প্রথমে হ্যাচারী আনারুলের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে ইমান আলী ও সফেদ আলীর বাড়ির ফটকের তালা ভেঙে ভাঙচুর চালায়। সশস্ত্র হামলাকারিরা একে একে কয়েকটি বিষ্ফোরন ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে গোটা গণপথ দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা চান তারা।

একপর্যায়ে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে রমেশ স্বর্ণকারের ঘেরের বাসার পাশে অবস্থানকারি হামলাকারিদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ সময় বেশ কয়েকজন হামলাকারি খাল পার হয়ে পালিয়ে গেলেও চার নারীসহ ১৬জনকে আটক করে গণপিটুনি দেয় গ্রামবাসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পাশপাশি ভ‚মিহীনদের পিটুনিতে আহত ভ‚মিদস্যু বাহিনীর লোকজনকে চিকিৎসার জন্য সখীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠায় পুলিশ। তবে হামলাকারিদের পিছনে উপজেলার এক শীর্ষপর্যায়ের জনপ্রতিনিধির ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

ঢেপুখালির এক সময়কার বাসিন্দা হামলাকারি রুহুল আমিনের মামা ছাকা মোড়ল জানান, তিনি বর্তমানে কালিগঞ্জের নলতা ইউনিয়নের দুড়দুড়িয়া গ্রামে বসবাস করেন। কয়েকদিন আগে ঢেপুখালি গ্রামে বসবাসকারি চাচিাত ভাই হ্যাচারী আমিরুলের বাড়িতে এসে জানতে পারেন যে ওইসব জায়গা ভাগ্নে রুহুল আমিনের নেতৃত্বে দখল করা হবে একজন উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতার ইচ্ছায়। এ ঘটনা থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি ভাগ্নে রুহুল আমিনকে সতর্ক করলেও সে হামলা চালিয়েছে।
দেবহাটা থানার পুলিশ পরিদর্শক নুরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ছয়টি রাম দা, দুটি হাসুয়া, একটি কুড়াল ও চারটি গুলতি উদ্ধার করেছে। গণধোলাইয়ের শিকার ১৬ জনের মধ্যে ১৩ জনকে সখীপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিকেলে নয়জনকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রয়াত ইমান আলীর স্ত্রী সালেয়া খাতুন বাদি হয়ে আটককৃত ১৬জনসহ অজ্ঞাতনামা ২৫/৩০ জনের নামে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। চিকিৎসাধীন ব্যতীত কয়েকজনকে শুক্রবার আদালতে পাঠানো হবে।

(আরকে/এএস/জানুয়ারি ১৯, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test