E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

লুটপাট হচ্ছে বেতনা নদী খননের মাটি

সাতক্ষীরায় বিদ্যালয়ের পাশে গড়ে উঠেছে ইটভাটা, জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে

২০২৪ জানুয়ারি ২৬ ১৯:০২:২৭
সাতক্ষীরায় বিদ্যালয়ের পাশে গড়ে উঠেছে ইটভাটা, জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার বেতনা নদীর খননকৃত মাটি প্রকাশ্যে বিক্রি করছেন একটি চক্র। এ ছাড়া ওই মাটি যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ইটভাটাগুলিতে। ইটভাটা, ছাড়াও পার্শ্ববর্তী গ্রামের ব্যক্তিমালিকানা পুকুর ও ডোবা ভরাটের পাশাপাশি কৃষি জমি উঁচু করতে ব্যবহৃত হচ্ছে বেতনা খননের ওই মাটি। মাটিবহনে প্রতিদিন সকাল থেকে ৩০ থেকে ৪০টি ট্রলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সদর উপজেলার মাছ খোলা ব্রীজ থেকে বিনেরপোতা ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তায়। ফলে  সদরের মাছখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও তালা উপজেলার বেড়ারডাঙি শতদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রয়েছেন চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই সাতক্ষীরার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের পাশে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। নিষিদ্ধ হলেও দেদারছে পুড়ছে জ্বালানী কাঠ। বিদ্যালয়ের পাশে ইটভাটা গড়ে উঠায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য। আর জনবসতির পাশে ভাটা গড়ে উঠায় হুমকির মধ্যে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চললেও প্রতিকার না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা।

সরেজমিনে গত বৃহষ্পতিবার সকালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বেতনা নদী সংলগ্ন শাল্যে ও মাছখোলা এলাকায় যেয়ে দেখা গেছে তিন বছর আগে শুরু হওয়া বেতনা খননের মাটির স্তুপ থেকে একটি চক্র ৩০ থেকে ৪০টি ট্রলির মাধ্যমে মাটি নিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী এলাকা ও স্থানীয় কয়েকটি ইটভাটায়। ফলে মাছখোলা ব্রীজ থেকে বিনেরপোতা ব্রীজ পর্যন্ত মাটির রাস্তা ধুলোয় ভর্তি হয়ে গেছে। অতিরিক্ত ধুলোর কারণে ওই রাস্তার নিকটবর্তী বসতিগুলোতে বসবাস করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী ও ওই এলাকায় বেড়ারডাঙি শতদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাছখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট করেই বিশেষ করে নাকে রুমাল দিয়েই চলাফেরা করতে হচ্ছে। দরজা ও জানালা খোলা থাকায় ক্লাসরুম ধুলোয় ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এলার্জিজনিত শ্বাসকষ্ট, জ্বর, চুলকনা, পাঁচড়া রোগে ভুগছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসি।

বেড়াডাঙি শতদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র দয়াল বিশ্বাস জানায়, তার বাড়ি স্কুল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। মাছখোলা- বিনেরপোতা মাটির সড়ক দিয়েই তাকে প্রতিদিন স্কুলে আসতে হয়। বেতনা নদী খননের মাটি বহনকারি ট্রলি মাটি নিয়ে লোকালয়ে ও ইটভাটায় দাপিয়ে বেড়ানোর ফলে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। মুখে মাস্ক পরে, রুমাল চেপে ধরেও রেহাই পাওয়া যায় না। এরপর স্কুলেে জানালা- দরজা খোলা থাকায় রাস্তার ধুলো শ্রেণীকক্ষে ঢুকে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে। এতে করে তাদের প্রতিনিয়ত জ্বর, সর্দ্দিকাশি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগতে হয়। এতে অনেকেই প্রতিদিন স্কুলে আসে না।

চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী তাসলিমা খাতুন বলে,শুকনোর সময় রাস্তার ধুলো ও বর্ষাকালে ধুলা থেকে কাদা তাদের নিত্যসঙ্গী।

মাছখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র রফিকুল ইসলাম জানান, স্কুলের পার্শ্ববর্তী রাস্তাটি অনেক উঁচু হওয়ায় ধুলো উড়ে তাদের ক্লাসের ভিতরে ঢোকে। একদিনে তিন থেকে চারবার ক্লাসরুম পরিষ্কার করতে হয়।

মাছখোলা গ্রামের রুহুল কুদ্দুস জানান, বেতনা নদীর পাড়ে জমা করা বেতনা খননের ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু মাটি স্থানীয় মােটি খেকো সালামসহ একটি গ্রুপ বিক্রি করছে স্থানীয় ইটভাটায় বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর ও নীচু জমি ভরাটের কাজে। অবৈধভাবে মাটি বিক্রির ফলে একইসাথে বেশ কয়েকটি ট্রলি মাটি বহন করে চলেছে প্রতিদিন। ফলে রাস্তার বারো বেজে গেছে। ধুলোর কারণে শুধু স্কুল নয়, এলাকাবাসীর বসবাস করা মুশকিল হয়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না। তাছাড়া এখানকার এক বড়মাপের আওয়ামী লীগ নেতা নেপথ্যে এ মাটি বিক্রি সি-িকেটের সঙেআগ জড়িত। একই কথা বলেন শাল্যে গ্রামের আমিরুল ইসলাম।

তিনি জানান, বিনেরপাতা থেকে মাছখোলা ব্রীজের মধ্যবর্তী স্থানে কমপক্ষে আটটি ভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় কোন ঝিকঝাক চিমনি নেই। অধিকাংশ ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে জ্বালানী কাঠ। একদিকে রাস্তার ধুলো অপরদিকে ভাটার চিমনির কালো ধোঁয়ায় ওষ্ঠগত প্রাণ। মাটি খাদকরা শুধু বেতনার খননকৃত মাটি কেটে বিক্রি করে ক্ষান্ত হয়নি। কেটে নিয়ে গেছে বেড়াডাঙি শ্মশানের মাটি। এ ছাড়া কাঁচা ইট ও পোড়ানো ইট বহনকাজে ব্যবহৃত ট্রাক আরো বেশি ধুলো ছড়াচ্ছে।

বেড়াডাঙি শতদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা তুলী বকসী জানান, রাস্তার প্রচ- ধুলোর মধ্য দিয়ে তাকে সাত কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে আসতে হয়। সাথে থাকে তার সাত বছরের ছেলে। ধুলো প্রতিরোধে তারা মাঝে মাছে রাস্তা অবরোধ করেছেন। পরদিন রাস্তায় পানি দেওয়া হতো। পরে আবার যা- তাই। ধুলোর কারণে সর্দি , কাশি ,জ্বর ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছে শিক্ষার্থীরা। অনেকে স্কুলে আসে না। কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থী। বিষয়টি তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের অবহিত করে প্রতিকার পাচ্ছেন না।

মাছখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহজাহান কবীর জানান, পার্শ্ববর্তী ধুলিপূর্ণ রাস্তার কারণে তাদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এর একটা প্রতিকার হওয়া দরকার।
গোপীনাথপুর এসবি ভাটার ম্যানেজার গোলাম নবী জানান, রাস্তা ব্লেড দিয়ে কেটে সমান করা হয়। অঅর সাটি ভাটার য়যনার আগে পানি দেওয়া হয় রাস্তায়। অন্য কোন ভাটায় জ্বালানী কাঠ ব্যবহার হলেও তার ভাটায় হয় না । অন্যের দায় তিনি নিতে যাবেন কেন?

তবে স্থানীয় দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকায় ৯৬টি ইটভাটা রয়েছে। অন্যদিকে ভাটামালিকদের তালিকা অনুযায়ী ইটভাটা রয়েছে ১১৮টি,যার মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র ২৪টির।

সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাধব চন্দ্র দত্ত জানান, জেলায় ১২৮টি ইটভাটা রয়েছে। যেগুলো মাটি কেটে পরিবহন করে ভাটায় নিয়ে যায়। বেড়াডাঙ্গি এলাকায় অবস্থিত ভাটাগুলো অনবরত ট্রাক অথবা ট্রলি দিয়ে মাটি পরিবহন করে নিয়ে যাচ্ছে। স্কুল ও জনবসতির পাশে ভাটাগুলো বন্ধে সরকারি উদ্যোগ দরকার। ১২৮টি ভাটার কিছু কিছুর বিরুদ্ধে প্রশাসন কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে। অবৈধ যেসব ভাটা রয়েছে,সেগুলো বন্ধ করার আহবান জানান তিনি।

সাতক্ষীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সরদার শহীদুল ইসলাম জানান, বেতনা খননের ফলে প্রচুর মাটি জমা রাখা হয়। সেই মাটি কিছু শর্তে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। তবে তারা শর্ত মানছেন কিনা তার মনিটরিং সেভাবে করা যায়নি। আর যারা ভাটায় ঝিকঝাক পদ্ধতি করেননি বা জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামা হবে। ঝিকঝাকে অন্তত কালো ধোয়া বের হয়না।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ২৬, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test