E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

কারাগারে মহেশখালীর দুই রাজাকার

২০১৫ মার্চ ০২ ১৭:২২:৩৮
কারাগারে মহেশখালীর দুই রাজাকার

স্টাফ রিপোর্টার : মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার হওয়া কক্সবাজারের মহেশখালীর দুই রাজাকারকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন এলডিপির নেতা কক্সবাজার চেম্বারের সাবেক সভাপতি সালামত উল্লাহ খান ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ রশিদ মিয়া।

সোমবার সকালে সালামত উল্লাহ খান ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়াকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারপতি চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল এ সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।

কক্সবাজার জেলার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের দুইজন সালামত উল্লাহ খান ও মোহাম্মদ রশিদ মিয়ার সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ একই মামলার অপর আসামি হচ্ছেন মহেশখালীর জাকারিয়া সিকদার। রবিবার এ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও আগামী ১৮ মার্চ তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানিয়েছিলেন প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল।

এরপর দুপুরে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশের একটি দল শহরের নিজ বাসভবন থেকে সালামত উল্লাহ খানকে গ্রেফতার করে। প্রায় একই সময় মহেশখালী থানা পুলিশ অপর আসামি বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মো. রশিদকে গ্রেফতার করে। তবে এখন পর্যন্ত জাকারিয়া সিকদারকে গ্রেফতার করা যায়নি।

পুলিশ জানায়, কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীতে মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে চকরিয়া থানার মামলায় ১৯ জন, পেকুয়া থানার মামলায় দুইজন ও মহেশখালী থানার মামলায় তিনজন আসামি রয়েছেন।

গ্রেফতার হওয়া দুইজন মহেশখালী উপজেলার মামলার আসামি। এর মধ্যে মোহাম্মদ রশিদ মিয়া ছিলেন মহেশখালী থানার তৎকালীন কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ও শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সালামত উল্লাহ খান ও অপর আসামি জাকারিয়া সিকদার ছিলেন তার সহযোগী।

অভিযোগে বলা হয়েছে, এই তিন রাজাকার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সমর্থক, সংগঠকসহ সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তার জন্য কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানা শান্তি কমিটি গঠন করে।

এরপর থেকে তারা মহেশখালী থানা এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিতকরণসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।

মহেশখালী থানায় বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ পাহাড়ি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নিয়ে গিয়ে এলাকার ৯৪ জনসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহেশখালীতে আশ্রয় নেওয়া অগণিত লোককে হত্যা করেন তারা। এছাড়া হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দুদের বাড়িঘর দখল করে তারা তা মসজিদে রূপান্তরিত করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত লোকজনদের সেখানে নামাজ পড়তে বাধ্য করেন। যে সমস্ত হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার জন্য খৎনা করানো হয়েছিল তাদের অনেকেই পরবর্তীতে ধনুস্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এ তিনজন এলাকার অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ ও অনেককে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করতেও বাধ্য করেন। এর মধ্যে জাকারিয়া সিকদার নিজেই পুলিন বিহারী পালের কন্যা শিখা রানীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। পরবর্তীতে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করেন। এমনকি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য করেন তিনি।

অভিযোগে বলা হয়েছে, এ তিনজন ৩০ এপ্রিল দুষ্কর্মের সহচরদের নিয়ে মহেশখালী থানার কালারমারছড়া বাজারে বাদ মাগরিব ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কথিত শান্তির লক্ষ্যে একটি শান্তি মিটিংয়ের আয়োজন করেন। শান্তি মিটিংয়ে স্থানীয় কালারমারছড়ার ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মো. শরীফ আহমদকে চাতুরির আশ্রয় নিয়ে সভাপতি করে অভিযুক্ত তিনজনের যোগসাজশে কথিত সভা শুরু হয়। তাদের গোপন ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তৎকালীন মহেশখালী থানার ওসি শামসুল হকের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র পুলিশ ওইদিন রাত আনুমানিক আটটার দিকে কালারমারছড়া বাজারে অনুষ্ঠিত কথিত শান্তির মিটিংস্থলে উপস্থিত হয়। ওই সময় কথিত শান্তির মিটিংয়ে উপস্থিত শান্তি কমিটির লোকজন পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ‘পাঞ্জাবি এসেছে, পাঞ্জাবি এসেছে’ বলে হই-হল্লা শুরু করে। তাদের ওই হই-হল্লা আতঙ্কিত হয়ে সভায় উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক লোকজন প্রাণভয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করেন।

উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ওই মুহূর্তে সালামতউল্লাহ খান ও মৌলভী জাকারিয়া সিকদারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মহেশখালী থানার তৎকালীন কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রশিদ মিয়া তার হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে শরীফ আহমদ চেয়ারম্যানকে গুলি করেন। একই সঙ্গে মহেশখালী থানার তৎকালীন ওসি শামসুল হক নিজের পিস্তল দিয়ে একই কায়দায় শরীফ চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে গুলি করেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩ মে সকাল আনুমানিক এগারোটার দিকে কালারমারছড়া ইউনিয়ন অফিসের সামনে থেকে হত্যার উদ্দেশ্যে আটক করা হয় শফিকুর রহমান ও ইউনুচকে। ৬ মে বিকেল আনুমানিক ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে আটককৃতদের হাত, চোখ বেঁধে কক্সবাজার আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন আসামিরা। পরবর্তীতে আটককৃত শফিকুর রহমান ও ইউনুচকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৫ মে দুপুরে পাকিস্তানি সেনারা কক্সবাজারে সদরে আগমন করে সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ খবর পেয়ে ওইদিনই এ তিনজন তাদের সহযোগী, শান্তি কমিটি ও নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের অনুসারী লোকজনদের নিয়ে মহেশখালী থানা এলাকা থেকে নৌকাযোগে কক্সবাজার সদরে এসে পাকিস্তানি পতাকা হাতে মিছিল সহকারে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে যান। তারা পাকিস্তানি সেনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে মহেশখালী এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে এর পরের দিন অর্থাৎ ৬ মে সকাল ১০টার দিকে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত দ্বীপাঞ্চল মহেশখালী থানার গোরকঘাটা জেটিঘাটে আসে। তারা একযোগে গোরকঘাটা বাজার এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের দোকানপাটে ব্যাপক লুটপাট চালায়, অনেককে হত্যা করে।

বাজার এলাকায় লুটপাট ও গণহত্যা সংঘটিত করার পর আসামিরা তাদের সহযোগীদের বিভিন্ন দলে ও গ্রুপে ভাগ করেন। এরপর নিজেরা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে পথ দেখিয়ে মহেশখালী থানার বিভিন্ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাসহ পাহাড়ি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে গিয়ে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রমণ চালিয়ে এলাকার ৯৪ জনসহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় আশ্রিত অগণিত লোককে হত্যা-গণহত্যা চালান।

(ওএস/এএস/মার্চ ০২, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test