E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্টপোষকতায় উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী

২০১৫ আগস্ট ০৯ ১৪:১৬:৫৪
সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্টপোষকতায় উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী

তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি:  আজ ৯আগষ্ট রবিবার বিশ্ব আদিবাসী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর থেকে আদিবাসীদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক, দারিদ্রতা, ভূমি জটিলতা আজও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নৃ-ত্বাত্তিক এই জনগোষ্ঠী কর্মহীন, অশিক্ষিত, স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত আর ভূমি বে-দখলসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তারা বংশ পরম্পরায় বসবাস করছেন। বর্তমানে সরকারী বেসরকারী পৃষ্টপোষকতায় উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা প্রতিকুলতা কাটিয়ে পথ চলা শুরু করেছেন। আর এ কাজে তারা প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে সফলতাও পেয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রায় ২৭ লক্ষ আদিবাসী রয়েছে। তার মধ্যে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ-রায়গঞ্জ উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার আদিবাসীর বসবাস।

আদিবাসীদের ইতিহাস: উত্তরাঞ্চলে কখন আদিবাসীদের বসবাস শুরু হয় তার কোন সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই। কারো কারো মতে মোগল আমলে আদিবাসীরা বাংলাদেশের এই অঞ্চলে আসেন। অনেকের মতে বৃটিশ শাসন আমলে ১৮৩১ সালে দুই জন আদিবাসী নেতাকে জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ৪০ হাজার আদিবাসীর এই দুই নেতা ছিলেন সিধু এবং কানু। এদের মৃত্যুর পর বিহারের নাগপুর থেকে আদিবাসীরা পূর্ব বাংলায় চলে আসে। ধারনা করা হয় ১৮৮৬ সালে তাড়াশ এবং রায়গঞ্জ অঞ্চলে জমিদাররা তাদের অনাবাদী বন জঙ্গল ঘেরা ভূমিতে শস্য উৎপাদনের জন্য এদের কাজ করায় ও জমিজমা তাদের কে সন ওয়ারী লীজ প্রদান করে। আদিবাসি নারী পুরুষ উভয় কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় অল্পদিনেই এই অঞ্চলে আদিবাসীরা গোয়াল ভরা গরু, পুকুরে মাছ ও গলা ভরা ধান নিয়ে সুখে শান্তিতেই ছিল।

আদিবাসীদের সংখ্যা: উত্তরাঞ্চলে ১৬ জেলায় প্রায় সাড়ে ২৭ লক্ষ আদিবাসী রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিছিন্নভাবে আদিবাসীদের বসবাস থাকলেও তাড়াশ-রায়গঞ্জে এদের সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। জেলায় আদিবাসী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। আদিবাসী গ্রামের সংখ্যা ১০৩টি। আদিবাসীর গোত্র রয়েছে ১৪টি। আদিবাসী মহিলা-পুরুষ মাঠে ঘাটে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। রোগে ভোগা কঙ্কালসার শরীর নিয়ে নারী-পুরুষ উভয়েই সমভাবে কাজ করে। অধিকাংশ পরিবার ঝুপরি, ছনের ঘর, পলিথিনের টঙ্গর ঘরে বসবাস করে।

গোত্র ধর্ম: উত্তরাঞ্চলের অঞ্চলে আদিবাসীদের একসময় অসংখ্যা গোত্র থাকলেও সময়ের ব্যবধানে এখন ১৪টি গোত্রের খোজ পাওয়া যায়। এরা হলো উরাঁও, মাহাতো, সাঁওতাল, বসাক, মুরারী, তুরী, সিং, রবীদাস, রায়, মাহালি ইত্যাদি। বর্তমান আদিবাসীদের মধ্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষনীয়। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৫শতাধিক পরিবার খ্রীষ্ট ধর্মে ধর্মান্তিরিত হয়েছে। আদিবাসীরা মনে করেন দারিদ্রতার কারণেই মূল ধর্ম থেকে অনেকেই বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আদিবাসী উৎসব: আদিবাসীদের জীবন থেকে নেওয়া সংস্কৃতি আজ মিশ্ররুপ ধারন করেছে। তাদের নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান কারাম উৎসব, ডাল পূজা, সোহরাই, এরোক, নিমদা মান্ডি, কেওহা টানাটানি, ফাগুয়া, ডাংরি পূজা, কঠিন চিবরদান, বিশ্বকর্মা, গোয়াল পূজার পাশাপাশি সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এদের দেখা যায়। তবে আদিবাসীদের নিজস্ব ৫-৭টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া অনেক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বিলীন হতে চলেছে তাদের জীবন ব্যবস্থা থেকে। বিভিন্ন এনজিও সহযোগিতায় উত্তরাঞ্চলের আদিবাসিরা এখনও সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস পালন করে আসছে।

আদিবসীদের সামাজিক চিত্র: আদিবাসি নারী পুরুষ উভয়েই মাঠে কৃষি কাজ, পশু পালন, তাঁতের কাজ, কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কালের বিবর্তনে নিজ জমি হাত ছাড়া হওয়ায় এ অঞ্চলে প্রায় ৯০ ভাগ আদিবাসী ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। তাড়াশ-রায়গঞ্জ এলাকায় ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে প্রায় ২শতাধিক মামলা রয়েছে। জমির জমা বিরোধের জের ধরে অনেকেই নিহত হয়েছে। আদিবাসীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ভূমি গ্রাসীরা নিরীহ আদিবাসীদের দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে এরা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহের প্রাণান্তর চেষ্টা করছে। তাছাড়া দুই উপজেলার ৭ হাজার পরিবারের মধ্যে প্রায় ৪হাজার পরিবার বিভিন্ন এনজিওর ঋণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পরেছে। এক জরিপে জানা যায় প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ এখনো খাস জমিতে বসবাস করে। ৩০ থেকে ৪০ভাগ মানুষ উথুলি বা অস্থায়ী বসবাস করে। যৌতুকের ভারে প্রতিটি পরিবার বিপর্যস্ত। শিক্ষা-দীক্ষায় এদের অবস্থান ৩০-৩৫ বছর আগের চেয়ে বেশী হলেও তাড়াশ-রায়গঞ্জ এলাকায় ৫০-৬০ জনের বেশী এম পাশ আদিবাসী পাওয়া যাবে না। তবে শিক্ষার প্রতি এদের আগ্রহ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত সমাজের শোষক শ্রেণির অত্যাচার নির্যাতনে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া আদিবাসীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। আদিবাসী বহুমূখী উন্নয়ন সংস্থা, উরাঁও ফাউন্ডেশন সহ বিভিন্ন এনজিও আদিবাসীদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করলেও আদিবাসীদের সংস্কৃতি, মাতৃভাষা, কৃষ্টি, মানবাধিকার ও শিক্ষা নিয়ে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এমনকি আদিবাসীদের নামের গোত্রীয় পদবী স্কুলে ভর্তির সময়ে পরিবর্তন হয়ে যায়। নানাভাবে অত্যাচারিত নিগৃহিত আদিবাসীরা যুগে যুগেই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।

আদিবাসীদের কথা: তাড়াশ উপজেলার গুল্টা বাজারের আদিবাসী পার্বতী উরাঁও, শিল্পী রানী, নির্মলা রানী উরাঁও মাঠে কাজ করতে গিয়ে বলেন সারা দিন কাজ করে ১০০-১৫০ টাকা পাই। এখানেও আমাদের মজুরী কম দেওয়া হয়। ৩৬৫ দিনের বেশীভাগ সময়ই পার্বতীরা মাঠে কৃষি কাজ করে। বাকি সময় বিলের শামুক, কাঁকড়া, কাছিম, মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করে। কেউ বা বাঁশ বেতের কাজ করে। আশ্বিন কার্তিক মাসে এদের সংসার প্রচন্ড অভাব দেখা দেয়। ক্ষোভে পার্বতী জানান আদিবাসীদের সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসেনি বরং গারোরা প্রতিনিয়তই আমাদের বাড়ীর জায়গা জমি দখল করতে থাকে। আমরা সারা দিন প্ররিশ্রম করে সংসার চালাই। সরকারী ভাবে আমরা তেমন সাহায্য পাই না। এমনকি ভিজিডি কার্ড বয়স্কভাতা বিধবা ভাতা থেকে আমরা অনেকাংশে বঞ্চিত। সন্ধারানী (৬০) জানান ৩ ছেলে ২ মেয়ে নিয়ে মাঠে কাজ করি। আমার ভাগ্যে বয়স্ক ভাতার কার্ড জুটেনি।

আদিবাসীদের বর্তমান অবস্থা: শিক্ষার ক্ষেতে বর্তমানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন অনেকাংশে এগিয়ে গেছে। দিন দিন শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক দিক দিয়েও অনেক সচেতন হয়েছে। বর্তমান সরকার আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু করেছেন। প্রতি বছর আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের লেখা পাড়ার জন্য সরকারী ভাবে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। তাড়াশ-রায়গঞ্জে বেসরকারীভাবে নিজস্ব ভাষায় ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আয় বর্ধক কাজের জন্য সরকারীভাবে তাড়াশের গুড়পিপুল গ্রামে তাঁত শিল্প চালু করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহন করে তারা ঘুরে দাড়াতে শিখেছে। তাড়াশের মিনতি রানী বসাক আদিবাসী নারী হয়েও অর্থনৈতিক ভাবে এবার রাজশাহী বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জয়িতা’র পুরস্কার পেয়েছেন। গুল্টা গ্রামের আদিবাসি নারী বাসন্তী রানী উরাও আদিবাসীদের নির্যাতন, অত্যাচার ও দারিদ্রতার ছোবলে ক্ষত বিক্ষতর মধ্যে থেকেও এক আদিবাসী মা দারিদ্রতা জয় করে তিন সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে সফলতা পেয়েছে। স্বামীহারা বিধবা বাসন্তি রাণী উরাঁও (৫০) এখন এ অঞ্চলে এক গর্বিত মা। ২ ছেলে ১ মেয়েকে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করিয়েছেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে আগের চেয়ে শিক্ষার হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, ম্যাজেষ্ট্রিটসহ সরকারী গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজে তারা সম্পৃক্ত হয়েছে। নেতৃত্ব বিকাশে অনেকেই আগের চেয়ে অনেক সচেতন। চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ছাড়া বিভিন্ন দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত তারা নির্বাচিত হয়েছে। দিনদিন মুল স্রোতধারায় তারা ফিরে আসতে শুরু করেছে।

আদিবাসীদের দাবী: জাতিসংঘ ঘোষিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ, পৃথক ভূমি কমিশন, জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, পৃথক মন্ত্রনালয়, উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ এসব দাবী দীর্ঘ দিনের। উপজাতি, সমতল ভূমির জাতির জন্য চাকুরী ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোঠা থাকলেও আদিবাসীদের ক্ষেতে চাকুরীর জন্য সংরক্ষিত কোন কোঠা নেই। তাড়াশ-রায়গঞ্জের আদিবাসি নেতা ও উরাঁও ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক যোগেন্দ্র নাথ টপ্প জানান, সরকারী চাকুরীর ক্ষেতে আদিবাসী কোঠা সংরক্ষণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাছাড়া আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আদিবাসী বহুমূখী উন্নয়ন সংস্থা, উরাঁও ফাউন্ডেশনসহ নানা নামে বে-সরকারী সংস্থা গড়ে উঠেছে। আদিবাসী সংস্কৃতি, কৃষ্টি, মাতৃভাষা রক্ষা, মানবাধিকার ও শিক্ষা নিয়ে সরকারী ও বেসরকারীভাবে অনেকেই এগিয়ে আসছে। দিনদিন তাদের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আদিবাসীরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

(এমএমএইচ/এলপিবি/আগস্ট ৯, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test