E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে সাজাপ্রাপ্ত জেলেদের পরিবারে চলছে হাহাকার

২০১৫ অক্টোবর ১৪ ১১:৪৬:১৩
শরীয়তপুরে সাজাপ্রাপ্ত জেলেদের পরিবারে চলছে হাহাকার

শরীয়তপুর প্রতিনিধিঃ ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শরীয়তপুরের পদ্মা-মেঘনার জল সীমায় ডিম ওয়ালা মা ইলিশ ধরতে গিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন পৌনে ২ শত জেলে। এদের পরিবারে চলছে এখন হাহাকার। এনজিও‘র  কিস্তি দিতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পরিবারের নারী সদস্যরা। তাদের সামনে এখন শুধুই হতাশা।

অর্থনীতিবীদদের ধারনা, দরিদ্র জেলেদের শুধুমাত্র সাজা বা জেল জরিমানাই একমাত্র ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ না, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে জেলেদের মাছ ধরতে বাধ্য করে বিভিন্ন এনজিও, আড়তদার ও মহাজনেরা। তাই অপরাধের সমান ভাগ তাদের উপরও চাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে।

২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর ১৫ দিন ছিল ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। এ সময় দেশের সকল প্রজনন এলাকায় মা ইলিশ শিকার, বিপনন, পরিবহন, মজুদ সম্পুর্ন নিষিদ্ধ ছিল। শরীয়তপুরেও ঘটেনি এর ব্যতিক্রম। কিন্তু পেটের তাড়না আর ঋনের দায় থেকে মুক্তি পেতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেও মা ইলিশ শিকার করতে গিয়ে ১৫ দিনের অভিযানে জেলার জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার ১ শত ৭২ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে ১ বছর করে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত। এ সকল সাজাপ্রাপ্ত জেলেদের পরিবারে চলছে এখন চরম অভাব। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি কারাগারে থাকায় পুরো পরিবারের উপর নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। সাজাপ্রাপ্ত জেলেদের প্রত্যেকের মাথার উপর রয়েছে বিভিন্ন এনজিও থেকে নেয়া ঋনের বোঝা। ফলে তাদের স্ত্রী-সন্তান এখন সময় মত কিস্তি পরিশোধ করতে না পাড়ায় পালিয়ে বেরাচ্ছে ঘর বাড়ি ছেরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু শরীয়তপুরেই না, এবছর দেশের ২০টি জেলার ১ হাজার ৩ শত ৬১ জন দরিদ্র জেলেকে এভাবে সাজা প্রদান করা হয়েছে। যাদের সকলের পরিবারেই দিন কাটছে একইভাবে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মোল্যাকান্দি গ্রামের আব্দুল হাকিম সরদার ও ইসহাক সরদার এই দুই ভাইয়ের উপর নির্ভশীল ছিল ১২ সদস্যের একটি বৃহৎ পরিবার। বিভিন্ন এনজিও থেকে তারা ৫০ হাজার টাকা ঋণ তুলে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতো। অভিযানের ৭ম দিনে তারা দুই ভাই মাছ ধরতে গিয়ে আটক হয় আইন শৃংখলা রক্ষাকারীদের কাছে। ভ্রাম্যমান আদালত তাদের দুজনকেই এক বছর করে সাজা দিয়ে কারগারে পাঠিয়েছে। তারা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবার পর গত ১২ দিনেও পেট পুড়ে এক বেলা খাদ্য জোটেনি পরিবারে কারোরই। দুচোখের পাতা এক করে এক মুহুর্তও ঘুমোতে পারেনি হাকিমের স্ত্রী রাবেয়া। কেউ তাদের এক কেজি চাউল দিয়েও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। ৫০ হাজার টাকা ঋনে সপ্তাহে ২ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ আর সৌর বিদ্যুতের সাড়ে ৬ শত টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় সীমাহীন গঞ্জনা সইতে হচ্ছে রাবেয়াকে। স্বামী-দেবরের কারামুক্তির জন্য সচেতন সমাজের কাছে দাবী জানিয়েছেন রাবেয়া বেগম।

শুধু রাবেয়াই নন, ঋনের দায়ে জর্জরিত দুলারচরের সাজাপ্রাপ্ত জেলে জামাল হোসেন ঢালীর স্ত্রী সালমা আক্তার, কাচিকাটার আব্দুর রহমান ছৈয়ালের স্ত্রী মেহেরুন নেছা, চরভাগা গৌরাঙ্গ বাজার এলাকার আলাউদ্দিন বেপারীর স্ত্রী মাফিয়া খাতুন, তারাবুনিয়া গুচ্ছ গ্রামের সিরাজ মোল্যার স্ত্রী হনুফা বেগম ও আবুল কালাম বেপারীর স্ত্রী রোজিনা বেগমসহ এমন শতাধিক গৃহবধু এখন স্বামীর কারমুক্তির জন্য ফরিয়াদ জানাচ্ছে দ্বারে দ্বারে ঘুরে।

বেসরকারি সংস্থা আশা এর উত্তর তারাবুনিয়া শাখার শাখার ঋণ প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. সুমন হাওলাদার জানান, শুধু এই উত্তর তারাবুনিয়া শাখায় তাদের ২ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যার বেশীরভাগ ঋন গ্রহিতাই হলো মৎসজীবি জেলে । এদের মধ্যে অনেক জেলের সাজা হওয়ায় নিয়মিত কিস্তি আদায় সম্ভব হচ্ছেনা ।

অপর দিকে শরীয়তপুরের স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসডিএস এর ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক পরিচালক বি,এম কামরুল হাসান বাদল বলেন, আমাদের সংস্থা থেকে ঋন গ্রহনকারী যে সব জেলেদের সাজা হয়েছে তাদের থেকে কিস্তি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করতে কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সরকারের পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন সাজাপ্রাপ্ত দরিদ্র জেলে পরিবারের থেকে কিস্তি আদায়ে শিথিলতা অবলম্বনে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করলে তা আমরা অবশ্যই মেনে চলবো।

শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোহসীন বলেন, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ডিম ওয়ালা মা ইলিশ শিকার করায় শরীয়তপুর জেলায় ১ শত ৭২ জন জেলেকে ১ বছর করে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আগামী দিনে প্রজনন মৌসুমে জেলেদের মাছ না ধরার শর্তে ভর্তুকি প্রদানের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রস্তাব দেয়া হবে। এছারাও মা ইলিশ না ধরতে মৌসুম শুরুর আগেই জেলেদের সচেতন করার ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

শরীয়তপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক মো. নুরুন্নবী আলম বলেন, জেলেদের শুধু সাজা প্রদান করেই ইলিশ রক্ষা করা সঠিক ব্যবস্থা হতে পারেনা। জেলেদের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরতে বাধ্য করে আড়ৎ মালিক, মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীরা। এই সাজার ভাগ তাদেরও হওয়া উচিৎ। তাই শুধু হতদরিদ্র জেলেদের উপর প্রশাসনিক খড়গ না ধরে তাদের সচেতন করে তোলার উপরও নজর দিতে হবে। প্রজনন মৌসুমে জেলেদের পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদানেরও ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, জাতীয় সম্পদ ইলিশ শিকার করে জেলেরাই শুধু লাভবান হয়না। অধিক লাভবান হয় মহাজন ব্যবসায়ীরা। তাই বিভিন্ন মৌসুমে ওই সকল ব্যবসায়ীকেও বাধ্য করতে হবে দরিদ্র জেলেদের ভর্তুকি প্রদানে।


(কেএনআই/এসএমএস/১৪ অক্টোবর, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test