E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরের শিক্ষক নেতাদের বই বাণিজ্য

২০১৬ জানুয়ারি ২৩ ১৬:০৪:২২
শরীয়তপুরের শিক্ষক নেতাদের বই বাণিজ্য

শরীয়তপুর প্রতিনিধি :সরকারি নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, হ্যান্ডবিল- লিফলেট ছাপিয়ে, প্রকাশকের সাথে চুক্তি করে, বাজারের নিন্মমানের বই কিনে পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। আর এ অবৈধ কাজটি প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে  করছে শরীয়তপুর সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতি।

বছরের পর বছর এ ভাবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকের পকেট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে মোটা অংকের বাণিজ্য করে যাচ্ছে শরীয়তপুরের শিক্ষক নেতারা।

চলতি বছরের প্রথম দিনেও সরকার দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর হাতে বিনা মূল্যে নতুন বই তুলে দিয়েছে। এর মধ্যে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি গ্রামার বইও দেয়া হয়েছে। কিন্তু, শরীয়তপুর সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতি সরকার কর্তৃক সরবরাহ করার পরেও এই চারটি শ্রেণির জন্য ঢাকার বাংলা বাজারের দেশ প্রকাশনী (হৃদয় প্রকাশনী) এর সাথে চুক্তি করে কয়েকজন লেখকের তিনটি করে বাংলা ও ইংরেজী ব্যাকরণ বই পৌঁছে দিচ্ছে শরীয়তপুরের বিভিন্ন পুস্তক বিক্রেতাদের দোকানে। স্কুলে স্কুলে হ্যান্ডবিল পাঠিয়ে তা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়ে ওই বই গুলো ক্রয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের। এভাবে এ বছর শরীয়তপুর সদর উপজেলার ২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ১২ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে প্রায় ৩৬ হাজার অবৈধ বই। যা থেকে শিক্ষক সমিতি অসৎ উপায়ে আয় করবে কমপক্ষে ১৮ লক্ষ টাকা।

এ চিত্র শুধু শরীয়তপুর সদরেই নয়। জেলার অপর ৫ উপজেলাতেও মোট ১৩১টি বিদ্যালয়ের অন্তত ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষকদের পছন্দের আর সরকারের অনুনমোদিত ব্যাকরণ, বিভিন্ন বাহারী নাম ও মোড়কে মোড়ানো নোট ও গাইড বই তুলে দেয়া হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে।

শরীয়তপুরের পুস্তক বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষক নেতারা তাদের খেয়াল খুশি মত বই পাঠ্য করে তা বিক্রি করতে বাধ্য করছে। এক সময় বিক্রেতারা এ সকল বই প্রকাশকদের কাছ থেকে ৬০-৭০ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে ক্রয় করে তা শিক্ষার্থীদের কাছে আবার ৩০-৪০ শতাংশ হ্রাসকৃত দামে বিক্রি করতো। কিন্তু এবছর শিক্ষক সমিতি প্রকাশনীর সাথে চুক্তি করে মাত্র ২০ শতাংশ কম মূল্যে বই কিনে তা ১০ শতাংশ টাকা ছাড় দিয়ে বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে, চলতি শিক্ষা বর্ষে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি শরীয়তপুর সদর উপজেলা শাখার কর্মকর্তারা তাদের সমিতির নামে হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে প্রথমে প্রতিটি স্কুলে তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরপর বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর হাতে হ্যান্ডবিলে থাকা পুস্তকের তালিকা অনুযায়ী বই গুলো ক্রয় করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমান সরকার প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামার বই বিনামূল্যে বিতরণ করার পরেও সরকারি দল সমর্থিত কতিপয় শিক্ষক নেতা তাদের খেয়াল খুশি মত চারটি শ্রেনিতেই তিনটি করে ব্যাকরণ বই পাঠ্য করেছেন।


শরীয়তপুর সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতির জনৈক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ২০১৫ শিক্ষা বর্ষে ঢাকার অনিক প্রকাশনীর সাথে চুক্তি করে এভাবে বই পাঠ্য করা হয়েছিল। তা থেকে প্রকাশনী সমিতিকে একটি মোটা অংকের টাকা কমিশন দিয়েছিল। যার থেকে ১০ লক্ষ টাকা শিক্ষক সমিতির ব্যাংক হিসাব নাম্বারে জমা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছর শুধু সভাপতি ও সম্পাদক তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে একটি অখ্যাত প্রকাশনীর সাথে চুক্তি করেছে। তা থেকে এবছর কত টাকা কমিশন পাবে, আর কত টাকাই সমিতিকে দেয়া হবে তা কারাে জানা নেই।

একই সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ আব্দুল হালিম ও রুদ্রকর নীলমনি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান মো. শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে ব্যাকরণ বই পাঠ্য করার বিষয়ে তারা কিছু জানেন না। এমনকি এভাবে সরকার কর্তৃক সরবরাহ করার পরেও গ্রামার বা ব্যাকরণ বই অনুমোদন দেয়া শিক্ষক সমিতির নীতি বহির্ভূত কাজ। তারা আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের উপর কোন বই ক্রয় করতে চাপিয়ে দেয়াটাকে আমরা সমীচিন মনে করিনা।

স্থানীয় রুদ্রকর নীলমনি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার মিতু, কানিজ সুলতানা জোহা ও ফাতেমা আক্তার জানান, প্রতি বছরই আমাদের হাতে এরকম তালিকা তুলে দিয়ে স্যারেরা বই কিনতে বলে। আর আমরা তা কিনে পড়তে বাধ্য হই।

শরীয়তপুর জেলা শহরের মোহনা বই বিতানের মালিক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা মত কিছু মানসম্মত প্রকাশনীর নোট-গাইড-ব্যাকরণ বই বিক্রি করি। এতে প্রকাশক আমাদের এর আগে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ টাকা কমিশন দিত। আমরা বই বিক্রির সময় শিক্ষার্থীদের শতকরা ৩০-৪০ টাকা ছার দিয়ে নিজেরাও ২৫-৩০ শতাংশ টাকা লাভ করতাম। কিন্তু এবছর শিক্ষক সমিতি তিনটি ব্যাকরন বইয়ের তালিকা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছে, তোমরা ঢাকার বাংলা বাজারের হৃদয় প্রকাশনী থেকে এই বই গুলো কিনে আনবে। এতে তোমরা ২০ শতাংশ কমিশন পাবে। এর মধ্য থেকে শিক্ষার্থীদের কাছে শতকরা ১০ টাকা কমে বিক্রি করে নিজেরা ১০ টাকা লাভ করবে। এখন আমরা এই বই গুলি কিনে এনে বিক্রি করছি। তাতে শিক্ষার্থীদের অনেক বেশী টাকা গুনতে হচ্ছে।

শরীয়তপুর জেলা শহরের অপর বই বিক্রেতা ছাত্র ভান্ডার পুস্তকালয়ের মালিক সুবল চন্দ্র পাল বলেন, শিক্ষক সমিতি কোন লাইব্রেরী মালিকের সাথে পরামর্শ না করেই তাদের মন মত বই পাঠ্য করে আমাদেরকে বিক্রি করার নির্দেশ দেয়। আমরা তাদের কথা মত এই বইগুলো বিক্রি করি।

শরীয়তপুর পালং বাজারের ফ্ল্যাক্সি লোডের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিন মিয়া বলেন, আমার তিনজন সন্তান হাই স্কুলে পড়ে। সরকার তাদের বিনা মূল্যে বই দেয়ার পরেও শিক্ষকদের নির্দেশে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে গাইড বই কিনে দিতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ, এত টাকা দিয়ে বই কেনার স্বামর্থ আমাদের নেই।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার একটি শীর্ষস্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক শিক্ষক জানিয়েছেন, যে সকল বই শিক্ষক নেতারা পাঠ্য করে সে গুলো মোটেই মানসম্মত নয়। এ সকল বই পাঠ্য করে নেতারা অনেক টাকা হাতিয়ে নেয়। গত বছর দুইজন শিক্ষক নেতা বই পাঠ্য করার কমিশনের টাকায় বিদেশ ভ্রমন করে এসেছেন।
অনেক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে, প্রকাশকদের সাথে কোন আর্থিক চুক্তির কথা অস্বীকার করে, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের একক সিদ্ধান্তে অবৈধ ব্যাকরণ বই পাঠ্য করানোর কথা স্বীকার করেছেন শরীয়তপুর সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও গঙ্গানগর আদর্শ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোতালেব খান । তিনি বলেন, অভিন্ন প্রশপত্র তৈরী করার স্বার্থে আমরা ওই সকল বই পাঠ্য করেছি।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি শরীয়তপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন রতন বলেন, শিক্ষক সমিতি কর্তৃক হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে, প্রকাশকের সাথে চুক্তি করে সরকারি সিদ্ধান্তের পরপিন্থী পুস্তক পাঠ্য করানোকে আমি পছন্দ করিনা। তবে, দেশের সকল এলাকাতেই পূস্তক পাঠ্য করিয়ে শিক্ষক সমিতি সামান্য কিছু মুনাফা গ্রহন করে, যা অসহায়-গরীব শিক্ষকদের কল্যানে ব্যয় করা হয়।

শরীয়তপুর জেলা শিক্ষা অফিসার নলীনি রঞ্জন রায় বলেন, বাজারের নিষিদ্ধ বই শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিলে তার দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। আর এ ব্যবস্থা চলতে থাকলে সরকারের শিক্ষা নীতি ব্যাহত হবে।


(এএফবি/এস/জানুয়ারি২৩,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test