E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাঁশখালীর গন্ডামারা গ্রাম এখন পুরুষশূণ্য

২০১৬ এপ্রিল ০৫ ১১:১৩:৪৪
বাঁশখালীর গন্ডামারা গ্রাম এখন পুরুষশূণ্য

চট্টগ্রাম (বাঁশখালী )প্রতিনিধি :চট্টগ্রামের বাশঁখালী এলাকায় বেসরকারি খাতে কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে এক সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন মারা গেছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান  এ খবর নিশ্চিত করেছেন

চট্টগ্রামের সাংবাদিক মিন্টু চৌধুরী জানিয়েছেন, পুলিশসহ মোট ১৯জন আহত হয়েছেন। পুরো গ্রামে এখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সেই সাথে রাতভর গ্রেপ্তার আতংকে গন্ডামারা ইউনিয়নের ঐ গ্রামটি পুরোপুরি পুরুষশূণ্য হয়ে পড়েছে। মিন্টু চৌধুরি বলছেন, আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। জানা যাচ্ছে, বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে এলাকার জনমত বিভক্ত হয়ে গেছে।

মিন্টু চৌধুরি জানিয়েছেন, ঐ প্রকল্প চালু হলে গ্রামটিতে লবণ চাষ ও চিংড়ি চাষ হবে, এবং তার ফলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে গ্রামবাসী বিক্ষুব্ধ ছিল। তবে, গ্রামেরই আরেকটি পক্ষ ঐ প্রকল্পের পক্ষে অবস্থান নেয়। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চলার পর গতকাল তা সহিংস সংঘর্ষে রূপ নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে পুলিশও এক পর্যায়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।-বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন ।


চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কয়লাভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিরোধের জের ধরে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় গুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন দাবি করেছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, তারা চারজনের লাশ পেয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের সদস্য। সংঘর্ষে পুলিশসহ আরো অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে।

উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের মুজিবকেল্লা এলাকায় গতকাল সোমবার বিকেলে এ সংঘর্ষ হয়। পুলিশ প্রথমে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। পরে তারা গুলি ছোড়ে।

গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে স্থানীয় প্রশাসন বলেছে, তিনজনের লাশ বাঁশখালী থানা হেফাজতে রয়েছে, একজনের লাশ আছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ চারজন হলেন আনোয়ার হোসেন আক্কু ও মতুর্জা আলী, জাগের আহমদ ও জাকের হোসেন। তাদের বাড়ি গণ্ডামারা ইউনিয়নেই।

সাতকানিয়া সার্কেলের সিনিয়র এএসপি এ কে এম এমরান ভুঁইয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন ও মতুর্জা আলী সম্পর্কে আপন ভাই। জাগের আহমদ তাদের মেয়ের জামাই। তাদের লাশ রয়েছে বাঁশখালী থানা পুলিশের হেফাজতে। আর জাকের হোসেনের লাশ রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বাঁশখালী থেকে তিনজনের লাশ মর্গে পাঠাবে পুলিশ।

ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন ও নাছির উদ্দিন রাতে জানান, তাঁরা ঘটনাস্থলে মর্তুজা আলী, আনোয়ার হোসেন ও জাগের আহমদের লাশ দেখেছেন। এ ছাড়া এক নারীর লাশও পড়ে থাকতে দেখেছেন তাঁরা। তবে ওই নারীর নাম জানাতে পারেননি। তাঁদের দাবি, ঘটনাস্থলে পুলিশ ও গ্রামবাসী মিলিয়ে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। তাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

তবে কোনো নারী মারা যায়নি বলে দাবি করেন এএসপি এমরান ভূঁইয়া। তাঁর ভাষ্যমতে, সংঘর্ষে কোনো নারীর মৃত্যু হয়নি। তবে আহত হয়ে থাকতে পারে।

ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান রাত সাড়ে ৮টায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই গ্রুপের সমাবেশকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু তা অমান্য করেই সমাবেশ আয়োজনকারী স্থানীয় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করলে পুলিশের ওপর হামলা করা হয়। তখন আত্মরক্ষার্থে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছোড়ে।’

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনায় বাঁশখালী থানার ওসি স্বপন কুমার মজুমদারসহ ১১ পুলিশ-আনসার সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে চার-পাঁচজন গ্রামবাসীও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।’

জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নে। বঙ্গোপসাগরের তীরে কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। এতে এস আলম গ্রুপ ৭০ শতাংশ অংশীদার বলে জানা গেছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতাকারী পক্ষটি ‘ভিটামাটি রক্ষাকারী এলাকাবাসী’র ব্যানারে আন্দোলন করছে। তাদের অভিযোগ, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গণ্ডামারা ইউনিয়নের বড়ঘোনায় জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু ভিটামাটি ও বঙ্গোপসাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয়রা এ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে। ভিটামাটিহারাদের পুনর্বাসনের সুযোগ না দিয়েই জমি অধিগ্রহণ করায় স্থানীয়রা বসতভিটা হারাচ্ছে। অন্যায্যভাবে অধিগ্রহণের কারণে ওই এলাকার হাজার হাজার লবণচাষি ও চিংড়িচাষি বেকার হয়ে পড়বে।

তবে এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে এমন দাবি নাকচ করা বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে ইতিমধ্যে ৬০০ একর জমি কেনা হয়েছে। সাফকবলা করে এসব জমি নেওয়া হয়েছে। বেশির জায়গায় কোনো স্থাপনা নেই।

এরই মধ্যে গত শনিবার বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া এলাকাবাসীর সঙ্গে এস আলম গ্রুপের লোকজনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এস আলম গ্রুপের পক্ষে বাঁশখালী থানায় একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় রবিবার রাতে গণ্ডামারা থেকে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে লিয়াকত আলী চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গতকাল মানববন্ধনসহ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। গণ্ডামারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামশুল আলম মাস্টার পাল্টা সমাবেশের ডাক দেন। দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ডাক দেওয়ায় ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামসুজ্জামান।

গতকাল বিকেল ৩টায় ইউএনও এবং বাঁশখালী থানার ওসি ঘটনাস্থলে যান। সেখানে তখন বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ সময় পুলিশ হ্যান্ডমাইকে ১৪৪ ধারা জারির বিষয়টি জানায়। এর মধ্যে একপর্যায়ে স্থানীয় দুটি পক্ষ একে অন্যের ওপর হামলা চালায়। এক পক্ষের লোকজন পুলিশকে ঘেরাও করে ফেলার চেষ্টা করে। তখন পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং পরে গুলি ছোড়ে। এ ছাড়া দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময়ও গুলিবিনিময় হয়। ত্রিমুখী এ সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের কারণে ঘটনাস্থল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শেষে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে পিছু হটে গণ্ডামারা ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নেয়।

প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন, নাছির উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন রাতে মোবাইল ফোনে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট হ্যান্ডমাইকে সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারির কথা প্রচারের সময়ই ঘটনাস্থলে ৩০-৪০টি মোটরসাইকেলে চড়ে একদল যুবক আসে। পুলিশ সমাবেশ বন্ধের ঘোষণা দিতে শুরু করলে স্থানীয়রা মিছিল শুরু করে। মিছিল নিয়ে স্থানীয়রা যখন মুজিবকেল্লায় পৌঁছায় তখনই পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। পরে তারা গুলি ছোড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, মোটরসাইকেলে চড়ে আসা যুবকরাও গুলি চালিয়েছে। এতেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তারা জানায়, নির্বিচারে গুলিবর্ষণের সময় গ্রামবাসী দৌড়ে পালাতে থাকে। এর পরও গুলি বন্ধ হয়নি।

তবে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করেন, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশকে ঘেরাও করে ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ হামলা করা হয়। এই কারণে পুলিশের ১১ জন সদস্য আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর দেওয়া তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মোটরসাইকেলে যুবক এসে গুলি চালানোর বিষয়টি শোনা গেছে। তবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে সিনিয়র এএসপি এমরান ভুঁইয়া জানান, দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ভারী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। একই পরিবারের যে তিনজন মারা গেছেন তাঁরা একদিকে ছিলেন। তাঁদের দিকে ভারী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। ওটা নিশ্চয়ই তাঁদের প্রতিপক্ষের কাজ।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) আবদুল আউয়াল গত রাতে জানান, দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ডাক দেওয়ায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। পুলিশ সমাবেশ বন্ধ করতে যাওয়ার পর সেখানে ১০-১২ হাজার গ্রামবাসী পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘেরাও করার চেষ্টা করে। তখন আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুড়ি ছোড়ে।

ঘটনার বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামসুজ্জামান বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে-বিপক্ষের লোকজন একই স্থানে সমাবেশের ডাক দিলে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভেঙে দুটি পক্ষ সমাবেশ করতে চাইলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। তখন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ তাদের থামানোর চেষ্টা করে। সেখানে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ও গ্রামবাসী আহত হয়েছে।’

ঘটনার বিষয়ে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সহকারী সমন্বয়কারী বাহাদুর আলম কালের কণ্ঠ’র বাঁশখালী প্রতিনিধিকে বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা প্রকল্পের কাজে বাধা দিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে সমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। আর সন্ত্রাসীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে হামলা করেছে।’

তবে রাতে বাহাদুর আলমকে দ্বিতীয় দফা ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। একইভাবে প্রকল্পের পরিচালক (কারিগরি) শহিদুল আলমকেও ফোনে পাওয়া যায়নি। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে। এই কারণে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সংঘর্ষের এ ঘটনা তদন্তে নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেছেন, ‘বিদ্যুৎসচিবকে নির্দেশ দিয়েছি ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটি করার জন্য।’

ঘটনার বিষয়ে দুটি মামলা হবে বলে জানিয়েছেন সিনিয়র এএসপি এ কে এম এমরান ভুঁইয়া। গত রাতে তিনি বলেন, মৃত্যুর ঘটনায় ওই পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া এবং পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।

এদিকে বাঁশখালীতে হতাহতের ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।



(ওএস/এস/এপ্রিল০৫,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test