E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হালুয়াঘাটে জন্মের আগেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি,পাচ্ছেন ভাতা

২০১৬ অক্টোবর ১৬ ১১:৫০:৪১
হালুয়াঘাটে জন্মের আগেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি,পাচ্ছেন ভাতা

হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : হালুয়াঘাটে জন্মের আগেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাচ্ছেন ভাতা। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার ছড়াছড়ি। উপজেলার কিছু অসাধু মুক্তিযোদ্ধার যোগ-সাজশে সরকার কর্তৃক নির্ধরিত যুদ্ধকালীন সময়ে যাদের বয়স ১৩ বৎসর এবং মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অর্ন্তভূক্তি করার কথা থাকলেও হালুয়াঘাটে চলছে তার ব্যতিক্রম।

জানা যায়, দেশ স্বাধীনের ৪৫ বৎসর অতিবাহিত হলেও উপজেলায় ৩৫ বৎসর বয়সেও মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন ভূবনকুড়া ইউনিয়নের আচকিপাড়া গ্রামের মানুয়েল স্নাল (৩৫), আমির খা কুড়া গ্রামের পলিনুস সাংমা (৪৫), গাজিরভিটা ইউনিয়নের ঝাটাপাড়া গ্রামের শেখেন ঘাগ্রা (৪৫)। এছাড়াও মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় ভূয়া ব্যক্তির ছবি ও নাম সম্বলিত করে তালিকায় অর্ন্তভূক্তি করে জীবিত দেখায়। নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক লেনদেনের ছড়াছড়ি।

সমাজসেবা অফিসসূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ৩৭০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকলেও ভাতার তালিকায় অর্ন্তভূক্তি রয়েছে ৩৪১ জন। পক্ষান্তরে ভাতা পাচ্ছেন ৩২৮ জন। ১১টি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বহির কোন হদিস নেই। লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে চলছেন একটি অসাধু চক্র। বিভিন্ন মিথ্যে কথার ফুলঝুড়ি সাজিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া নিরীহ উপজাতীদের নকল প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযযোদ্ধা সাজানো হয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যয় প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে। এই মর্মে জানিয়েছেন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমানউল্লাহ।

প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযযোদ্ধা সুভাস মারাক, প্রত্যুষ সাংমা ও মনেষ সাংমা জানান, তাদেরকে মৃত মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা উত্তোলনের কার্ড করে ব্যাংকে নিয়ে আসেন সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমানউল্লাহ। পরে প্রতিজনের নামে প্রথম পর্যায়ে প্রাপ্য ৩৬ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন। তাদেরকে মাত্র ৫০০ টাকা দিয়ে বিদায় করে দেন। এরপর আর কোনদিন টাকা পাননি বলে জানান। প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা করে মোট ১৮ মাসের ৩৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন হালুয়াঘাট মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আমানউল্লাহ। ঠিক এইরকম ভাবে বেতকুড়ি গ্রামের সিমন মাঝি (৫০),উত্তর বাঘাইতলা গ্রামের লুটিস রংদি (৫২),ও ফরিদ রিছিল (৫৫), উত্তর খয়রাকুড়ি গ্রামের নেপারসন রংদি (৫৫) ও দক্ষিন খয়রাকুড়ি গ্রামের কাঠমিস্ত্রি গনেশ সুত্রধর (৫০)। এদের নামে নকল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন এর কার্ড করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সকলেই তাদের সত্যতা নিজমুখে স্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, সরেজমিনে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে জমাটবাধা তথ্য। যে সমস্ত মুক্তিযযোদ্ধার নামে এদেরকে ভাতা উত্তোলনের কার্ড করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু কেউ মারা গেছেন বা কেউ নিখোঁজ রয়েছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে জালিয়াতির নীল নকশার সুত্রপাত করা হয়েছে।

তথ্যে আরো জানা যায়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা উত্তর বাঘাইতলা গ্রামের ধরনি রিছিল (ভারতীয় কল্যান ট্রাষ্ট নং-৮৮৬৪), এর স্থলে নকল মুক্তিযোদ্ধা বেতকুড়ি গ্রামের সুবাস মারাক, নিকুলাস মারাক(ভারতীয় কল্যান ট্রাষ্ট নং-৮৮২৫)এর স্থলে নকল মুক্তিযোদ্ধা বেতকুড়ি গ্রামের সীমন মাঝি ওরফে বাবরি রিছিল, সুরুজ রেমা (ভারতীয় কল্যান ট্রাষ্ট নং- ৮৭৯৯) এর স্থলে উত্তর বাঘাইতলার লুটিস রংদি,কুমারগাতি গ্রামের প্রদীপ সাংমা (ভারতীয় কল্যান ট্রাষ্ট নং- ৯০০১) এর স্থলে উত্তর বাঘাইতলা গ্রামের ফরিদ রিছিল,সুজিত মারাক (ভারতীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট নং- ৮৭৬১)এর স্থলে ঝাটাপাড়া গ্রামের সেকেন ঘাগ্রা ওরফে সুজিত ঘাগ্রা, লিলিশ রংদি (ভারতীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট নং- ৮৮৫৩) এর স্থলে উত্তর খয়রাকুড়ি গ্রামের নেপারসন রংদি, জয়রামকুড়া গ্রামের সন্তোষ মারাকের স্থলে সংড়া গ্রামের মনেষ সাংমা, জয়রামকুড়া গ্রামের তড়ক মানখিন (ভারতীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট নং- ৮৯৯০) এর স্থলে পলাশতলা গ্রামের প্রত্যুষ সাংমা, ভাষনপাড়া গ্রামের টস মারাক (ভারতীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট নং-৮৯৪০)এর স্থলে আচকিপাড়া গ্রামের মানুয়েল স্নাল, ওপেন মারাক (ভারতীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট নং-৯০০৬)এর স্থলে আমিরখাকুড়া গ্রামের পলিনুস সাংমা, নাগলা গ্রামের অভিনাস চন্দ্র দাস (ভারতীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট নং-৮৯১৬) এর স্থলে উত্তর খয়রাকুড়ি গ্রামের গনেশ চন্দ্র সুত্রধর কে প্রক্সি খাওয়া নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়েছে।

ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নকল মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে সুবাস মারাক, সিমন মাঝির নামে জুলাই/২০১০ খ্রি. হতে ডিসেম্বর /১৪ খ্রি. পর্যন্ত প্রত্যেকের নামে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার টাকা উত্তোলন হয়েছে। লুটিশ রংদি, ফরিদ রিছিল, মনেশ সাংমা, প্রত্যুষ সাংমা, মানুয়েল স্নাল, পলিনুস সাংমা, গনেশ সুত্রধর এদের প্রত্যেকের নামে জুলাই/১০ খ্রি. তারিখ হতে সেপ্টেম্বর/১৪ খ্রি. পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা উত্তোলন হয়েছে। সেকেন ঘাগ্রা জুলাই/১৩ থেকে ৬৬ হাজার টাকা,নেপারসন রংদি জুলাই/১৩ থেকে সেপ্টেম্বর /১৪ পর্যন্ত ৫১ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। সর্বমোট ১১ জন ভুয়া ও প্রক্সি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধার নামে মোট ১২ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা রাজস্ব খাত থেকে প্রতারনা পুর্বক উত্তোলন করা হয়েছে। নকল মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ প্রত্যেক কে প্রথম পর্যায়ে মাত্র ৫০০ টাকা প্রদান করে, বাকি টাকা সাবেক কমান্ডার আমানউল্লাহ গ্রহন করেছে।

এ বিষয়ে সাবেক কমান্ডার আমানউল্লাহর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা আমাকে দোষারূপ করছে, তারা মিথ্যা বলছে। নকল মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কতৃক প্রদত্ত পরিচয়পত্র দেখেই মুক্তিযোদ্ধার ভাতা উত্তোলনের সুপারিশ করেছি মাত্র। প্রক্সি খাওয়া নকল মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ব্যাংক থেকে নিজে টাকা উত্তোলন করেছেন এ বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযযোদ্ধা কবিরুল ইসলাম বেগ বলেন, আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর ৩৬ টি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলনের বহি বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভুয়া সন্দেহে জব্দ করেছিলেন যাচাই বাছাই করে কিছু সংখ্যক বহি ছেড়ে দিয়েছেন ভাতা উত্তোলনের জন্য এবং অল্প কিছু ভাতা উত্তোলনের বহি তাহার নিকট জব্দ রয়েছে বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল গনি, সদস্য সচিব ভদ্র ম্রং জানান, কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সহ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে যৌথ স্বাক্ষরে ৪৬ জন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছিলেন।

এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান বলেন, অত্র উপজেলায় ৩৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও ভাতার তালিকায় রয়েছে ৩৪১ জন। ভাতা পাচ্ছেন ৩২৮ জন। ১১টি ভাতা বহি নিখোজ রয়েছে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার হেলালুজ্জামান সরকার- এ প্রতিবেদক কে জানায়, অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জন্মের আগেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়টি অবান্তর। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেন। উল্লেখ যে, কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জেলা প্রশাসক বরাবরে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দাখিল করেছিলেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওয়াহাব সহ একাধিক মুক্তিযোদ্ধা।







(জেসিজি/এস/অক্টোবর১৬,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test