E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ঈদ আনন্দ নেই টাঙ্গাইলের দেড় হাজার বেদে পরিবারে

২০১৭ জুন ২৩ ১৬:২২:৫৩
ঈদ আনন্দ নেই টাঙ্গাইলের দেড় হাজার বেদে পরিবারে

টাঙ্গইল প্রতিনিধি : টাঙ্গাইলের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করা প্রায় দেড় হাজার ভাসমান বেদে পরিবারে ঈদের আনন্দ নেই। এ বেদে সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো দিন-রাত ক্ষুধা নিবারণই যেখানে মূখ্য সেখানে ঈদের মতো অনুষ্ঠানে ভাল খাবার পাওয়ার আশাটা পুরণ হলেও নতুন জামা-কাপড়ের চিন্তাও তারা করে না।

টাঙ্গাইল শহরের নগরজালফৈ, জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয়ের পাশে পরিত্যক্ত ভূমি, ধুলেরচর মাদ্রাসা মাঠ(বনানী মাঠ), সদর উপজেলার পয়লা, রসুলপুর; কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা, পৌলী, হামিদপুর, বেতডোবা; মির্জাপুরের পোষ্টকামুরী এবং বাসাইল, গোপালপুর, ঘাটাইল, দেলদুয়ার, নাগরপুর উপজেলার বিভিন্নস্থানে বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ হাজার লোক বসবাস করে।

বঙ্গবন্ধুসেতু-ঢাকা মহাসড়ক সংলগ্ন উপ-শহর এলেঙ্গায় সরকারি খাস জমিতে বসবাসকারী ফাতেমার বয়স ২৪। বিয়ে হয়েছে একই সম্প্রদায়ের আ. রহিমের সঙ্গে, এক সন্তানের জননী। বেদে সম্প্রদায়ের সদস্য ফাতেমার মা লালবানু। অসহায় দরিদ্র লালবানু তার মেয়ে ফাতেমাকে পড়ালেখা শেখানোর খুব ইচ্ছে থাকলেও অভাবের কারণে পারেননি। ফতেমা ও তার মা লালভানু উভয় পরিবারেই ঈদ আনন্দ বলে কিছু নেই।

ফাতেমার বাবা মোহাম্মদ আলী জানান, তিনি মেয়েকে পড়ালেখা করাতে চেষ্টা করেছেন পারেননি। বাধ্য হয়ে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ছাতা মেরামতের কাজ করেছেন। এখন একাই কাজ করেন। ফাতেমার আলাদা সংসার হয়েছে, একজন বাচ্চাও আছে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তাবিজ-কবজ বিক্রি করতে হয়- দু’পয়সা আয় করার জন্য।

তিনি জানান, এ সম্প্রদায়ের ছোট ছেলে-মেয়েরাও পেটের তাগিদে কাগজ কুড়ানোর কাজ করে। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি করে। আমাদের আবার ঈদ কিসের? বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে একটু ভাল খাবার পাওয়া যায়- এতেই আমাদের ছেলে মেয়েরা খুশি।

একই এলাকায় বসবাসকারী ছয় বছরের ঝর্নার বাবা রহিম ও মা মরিয়ম বেগম গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ঘুরে মেলামাইনের বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করেন। ঝর্নারা তিন বোন দুই ভাই। একবোন জবা ও লতা টোকাইয়ের কাজ করে। ছোট এক ভাইয়ের বয়স তিন বছর আরেকভাই ছয় মাস বয়সের। মা, বাবা, বোন সকালের খাবার খেয়ে কাজের উদ্দেশে বেরিয়ে যায়- আসে সন্ধ্যায়। ঝর্নাকে ঘর পাহারা ছোট ভাইকে খাওয়ানো, গোসল করানো ও ঘুমপাড়ানোর কাজ করে। ওরও ইচ্ছে করে ঈদের দিনে অন্য শিশুদের মতো নতুন নতুন জামাকাপড় পড়ে-আতর গোলাপ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু ওদের সে স্বাধ প্রতি বছরই অপূর্ণ থেকে যায়।

একই পরিবারের কবিতা, লায়লা, ইমরান, সখিনা, মীমরা পাঁচ ভাই-বোন। তারা প্রত্যেকেই শিশু। ওদের বাবা রফিক আর মা আমেনা খাতুন মেলামাইনের তৈরি থালাবাসন নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। লাভ যা হয় তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে যায়। যেদিন ভাল কিছু রান্না করা হয় সেদিনকেই ওরা ঈদের দিন মনে করে। পৃথক কোন ঈদ ওদের জীবনে প্রভাব পড়েনা।

খোঁজ নিয়ে ও বেদে সম্প্রদায়ের বয়োবৃদ্ধ লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান বেদে সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ লোকজন মুসলিম। তারা নিজেদের মতো করে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে। এ সম্প্রদায়ে সনাতন তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাই এক সময় বেশি ছিল। কালের আবর্তে সে সময় আর নেই, এখন ইসলাম ধর্মের লোকজনই বেশি। বেদে সম্প্রদায় সাধারণত ভাসমান শ্রেণির। তাদের নিজস্ব কোন ভূমি বা বসত ভিটা নেই। সরকারি খাস জমিতে ছোট ছোট টুক্রা তুলে তারা বসবাস করেন। সাপ ধরাকে কেন্দ্র করে বেদে সম্প্রদায়ের অবির্ভাব হলেও বর্তমানে এঁরা অত্যন্ত মানবেতর জীবন-যাপন করে থাকে। এদের অবস্থান সাধারণত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে ওঠে। এক সময় এঁরা নদীতে নদীতে নৌকায় ঘুরে বেড়াত, নৌকাই ছিল তাদের ঘর-বাড়ি। নৌবন্দর, বড় কোন ঘাটকে ঘিরে ছিল তাদের জীবনযাত্রা। সময় পাল্টেছে তাই সড়ক-মহাসড়কের আশ-পাশে বেদে সম্প্রদায় ঠাই নিয়েছে। তারপরও তারা বেশিদিন এক জায়গায় স্থায়ী হয়না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও বসতি বদল করে থাকে।

টাঙ্গাইলে বসবাসরত সর্দার কান্দু মিয়া, রহিম বক্স, কালা সর্দার সহ বেদে সম্প্রদায়ের মুরব্বিরা জানান, এ সম্প্রদায়ে এখনও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব রয়ে গেছে। যদিও তারা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী নয় কিন্তু পরিবারের মেয়েরাই আয়-রোজগার করে। সারাদিন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে তাবিজ-কবজ বিক্রি করে, সিঙ্গা লাগায়, ঝাড়ফুঁক দেয়, কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করে দু’পয়সা আয়-রোজগার করে। আর পুরুষরা সাধারণত ঘর-সংসার সামলায়। রান্না-বান্না, বাচ্চা-কাচ্চা দেখাশোনা করে।

তারা জানান, এখন সময় অনেক পাল্টেছে, মানুষজন বিজ্ঞান মনস্ক হয়েছে- হয়েছে সচেতন। তারা এখন আর তাবিজ-কবজে বিশ্বাস করতে চায়না। এগুলোকে ভাওতাবাজী মনে করে। তাই এখন বেদে সম্প্রদায়ের ব্যবসাও নেই। অধিকাংশ বেদে শিশুরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বছরে ঈদের দিনের আনন্দ ওদের কাছে এখনও অচেনা।


(আরকেপি/এসপি/জুন ২৩, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test