E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প

২০১৬ জুন ০৬ ০০:১০:৫৭
আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প








 

কাঁচের চোখ ২

তোমরা কাঁচের চোখে দেখো তাই অনুধাবন করতে পারো না। কাঁচের চোখে দেখলে অনুধাবন করা যায় না। আজ মনুষ্য সমাজের এই চিত্র তোমাদের ঐ স্থির দৃষ্টির উপর পড়ে ঠিকই কিন্তু ঐ প্রতিবিম্ব তোমাদের মনকে আলোড়িত করে না। দৃষ্টির সাথে সাথে তোমাদের মনও আজ পাথরসম। অনুধাবন করার শক্তি, বিবেকের বিচার আর মনুষ্যত্ব নামের উজ্জ্বল জ্যোতি থেকে আজ তোমরা বিচ্যুত। তবে দেরি হয়নি খুব। তোমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রতিনিয়ত যারা চাতকের মতো চেয়ে থাকে তাদের আর্তি ভরা ডাকে সারা তোমাদেরকে দিতেই হবে, তোমাদেরকে ফিরতেই হবে।

রাহাত প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর একটি ছেলে। ওর তারুণ্য, ওর উদ্দাম আমার মধ্যে আশা জাগায়। ওরাই তো একদিন সমাজের অন্ধকার ঘোচাবে, বয়ে আনবে আলো। সেই আলোর ছোঁয়ায় আমরা আবার মানুষ হব। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো রাহাতের সাথে আমার দেখা হচ্ছে না। কলেজ মাঠে ব্যাট-বল হাতে অন্যদের দেখি কিন্তু তাকে দেখি না। ব্যাপার কী? অসুখ করল না-কি ? এগিয়ে গেলাম মাঠের দিকে। রাহাতের বয়েসি একটি ছেলেকে ডেকে বললাম,
-আচ্ছা, কয়েকদিন হলো রাহাতকে দেখছি না, ব্যাপার কী? ছেলেটি বলল,
-জানেন না ?
-কী জানব ?
-রাহাত কে কারা যেন মেরেছে।
-বলো কী ? কেন মেরেছে ?
-তা আমি জানি না। তবে মেরেছে নাকি খুব।
-বলো কী!
-বিশ্বাস না হলে ওর বাড়ি যেয়ে দেখুন না।
-আমি রাস্তায় ফিরে এলাম। মনে মনে ভাবলাম, তাহলে তো একবার যেতেই হয়।

রাহাতদের বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম সন্ধ্যা তখন হবো হবো করছে। ছোপ ছোপ অন্ধকার ছোট-বড় গাছের নিচে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ক্ষাণিক আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে তাই চারিদিকে কেমন একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ, মন খারাপ করা শ্যাঁতশ্যাঁতে ভাব। রাহাতদের বাড়ির সামনে লোকজনের বেশ একটা ভিড়। কান্নাকাটির সুর। ব্যাপার কী ? এত লোকজন কেন ? এগিয়ে গেলাম। গুঞ্জনে বুঝলাম রাহাতের বাবা মারা গেছেন। রাহাতের এক বন্ধুকে দেখলাম এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করতে সে বলল,
-হার্ট অ্যাটাক।
-কী ভাবে হলো ?
-সবাই তো বলছে বয়স হয়েছিল তাই কিন্তু বলা ঠিক না তবু বলতে হচ্ছে। আমার মনে হয় এর জন্য রাহাত অনেকটা দায়ী।
-মানে ?
-টিভিতে ক্রিকেট খেলা হয় দেখেন?
-হ্যাঁ দেখি। বাংলাদেশের খেলা হলে তো দেখি-ই। কিন্তু খেলা দেখার সাথে এই মৃত্যুর সম্পর্ক কী?
-অনেক বড় সম্পর্ক আছে। রাহাত সব খেলাই দেখতো।
-তাতে কী? ও খেলাধুলা করে, বাংলাদেশের খেলা ছাড়াও অন্যান্য দেশের খেলা হলে তা তো দেখতেই পারে।
-এ দেখা সে দেখা নয়।
-কেমন দেখা?
-রাহাত খেলায় বাজি ধরতো।
-মানে !
-হ্যাঁ, খেলা নিয়ে ও নিয়মিত বাজি ধরে জুয়া খেলতো।
-বলো কী ! ওকে দেখে তো তেমন মনে হয়নি।
-অভ্যাসটা গত এক বছর হলো ধরেছিল। আমি জানতে পেরেছি, গত তিন মাস আগে। কলেজ মাঠের খেলা ছেড়ে সন্ধ্যা বেলায় আমরা যখন বাড়ি ফিরে আসতাম রাহাত তখন মোড়ের দোকানে চলে যেত। ওর মতো আরো যারা আছে তারা সবাই এক জায়গায় জড়ো হতো। তারপর ওরা ফোনে এজেন্টেদের সাথে কথা বলতো।

-কী কথা বলতো ?

-তা আমি ঠিক ভালো বলতে পারব না। তবে দু’একদিন ওর মুখে শুনেছি, ফোনে বলতো, পাঁচটা চিকন, তিনটা মোটা ইত্যাদি। আমার মনে হয় সাংকেতিক ভাষা। সাংকেতিক ভাষায় ওরা জুয়া-বাজি ধরতো। দেশের দলের খেলা দেখার চেয়ে বিদেশি দলের খেলা দেখায় মনোযোগ দেখে ব্যাপারটা আরো বেশি সন্দেহ হতো। ওর পছন্দের দল হেরে গেলে মুখ কালো করে বসে থাকতো। প্রিয় দল হারলে মন খারাপ হয় জানি কিন্ত ওর মন খারাপটা খুবই চরম একটা অবস্থায় গিয়ে ঠেকতো।

বছর দেড়েক আগে ওর বাবা অবসরে গেছেন। ভদ্রলোক ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। পেনশন বেশ ভালই পেয়েছেন। রাহাত একমাত্র ছেলে তাই যখন যা চাইত ওর বাবা তাই দিতো। কিন্তু গত ছয় মাসে রাহাতের চাহিদাটা ভয়াবহ আকারে বেড়ে গিয়েছিল। দুই দিন অন্তর অন্তর পাঁচ হাজার, দশ হাজার করে চাইত। প্রথম দিকে দিলেও পরে ওর বাবা চেপে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে খুব। রাহাত জুয়ার নেশায় একেবারে বুঁদ হয়ে গিয়েছিল। টাকার জন্য মা-বাবার প্রতি বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করতো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেই জুয়ার নেশাটা ওর উপর শয়তান হয়ে ভর করতো। একদিন জিততো তো তিন দিন হারতো। হারের টাকা তেলার জন্য ওর মনের মধ্যে সব সময় একটা বিশ্রী উত্তেজনা কাজ করতো। উত্তেজনাকে বশে রাখতে মাঝে মাঝে নেশা জাতিয় দ্রব্যও ওকে নিতে দেখেছি। কতো বুঝিয়েছি, বন্ধু এটা খুব খারাপ কাজ, তুই তো এমন ছিলিস না। এসব বাদ দিয়ে ফিরে আয়। কিন্তু ও শুনতো না। বলতো, আমার নিজস্ব ব্যাপারে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবি না।

গত তিন মাসে রাহাতের জুয়ার নেশাটা একেবারে চুড়ান্তে গিয়ে পৌঁছেছিল। শেষের দিকে শুনেছি টাকার জন্য ওর বাবার গায়ে নাকি একবার হাত তুলেছিল। জন্মদাতা পিতার গায়ে হাত! বুঝুন তাহলে, ওর মানসিক অবনতিটা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল? ওর মা টাও অসুস্থ। টাকার জন্য শয্যাশায়ী মা কে নানান ভাবে ধমকাধমকি করতো। বৃদ্ধ মা রাহাতের অমন আচরণে সবসময় নিজের মৃত্যুই কামনা করতো। জুয়ার নেশা যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা রাহাতকে দেখে বুঝেছি। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা না পেলে বাড়ির এটা ওটা বিক্রি করে দিতো। যখন বিক্রি করার মতো কিছু না থাকতো তখন ধার করতো। মাঝে মাঝেই দেখেছি ধারের টাকা আদায় করতে সন্ডা মার্কা লোকজন ওদের বাড়িতে ঢুকেছে। উচ্চ-বাচ্যে ওর মা-বাবার সাথে কথা বলছে।

গত পনেরো দিনে রাহাতের দেনার পরিমাণটা বেশ বড় একটা অংকে গিয়ে ঠেকেছিল। যারা টাকা ধার দিয়েছিল তারা তাদের টাকা ফেরত পেতে বিভিন্ন ভাবে ওর উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল। এদিকে ওর বাবা এসব ধারের টাকা পরিশোধ করতে পারবে না বলে দেওয়ায় এক পর্যায়ে রাহাতকে ওরা খুব মারধর করে। রক্তাত্ব অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। ছেলের এমন দুর্দশা দেখে কোন্ মা-বাবা ঠিক থাকতে পারে? সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, এমন একটা ধাক্কা নিতে পারবেন কেন? চলে গেলেন।

মওলানা সাহেব এসে গেছেন। রাহাতের বাবাকে গোসল করানো হচ্ছে। ক্ষাণিক বাদেই কাফনের কাপড় পড়ানো হবে। দুঃখ হচ্ছে রাহাতের পিতার জন্য, দুঃখ হচ্ছে এই পরিবারটির জন্য। যে পিতা তার কষ্টে অর্জিত অর্থ দিয়ে তার সন্তানের ভরন পোষণ করেন, আদর-যন্তে তার চোখের মণিকে বড় করে তোলেন অথচ সেই সন্তানের জন্য আজ তার প্রাণ বায়ু নিঃশেষ হলো! যে ছেলের চোখে আমি দেখেছিলাম নতুন সূর্য, অন্তরে প্রাণ প্রাচুর্যের প্রাসাদ। সেই স্বপ্ন, সেই উদ্দাম আজ ভয়াবহ এই জুয়ার নেশায় এক নিমিষেই কর্পূরের মতো উবে গেল !

আজ দেশের জীবন্ত সোনা হরণ করছে যারা। সোনালি স্বপ্ন-মাখা ভবিষ্যতের গায়ে যারা দিচ্ছে আগুন। তাদেরকে রুখতে সমাজের কি কোনো দায়িত্ব নেই? দেশে আজ এতগুলো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, তাদের চোখে এই ভয়াবহ জুয়া কি কোনো অপরাধ নয় ? কোথায় গেছে আজ শুশিল সমাজ? টক শো-তে বক্তব্য দিতে না পারলে যাদের ঘুম হারাম হয়ে যায় এই ভয়াবহতার আঁচ কি তারা অনুধাবন করতে পারছেন না? দেশের তরুণ সমাজের প্রতি সরকারের চিন্তাভাবনার কথাগুলো কী ফট-ফট শব্দ তুলে শুধু খই-ই ফোটাবে? আজ লক্ষ-কোটি রাহাতরা মরণ নেশা এই ক্রিকেট জুয়ার অতল তলে হারিয়ে যাচ্ছে এটা কি দেশের জন্য ক্ষতি নয়?

আমরা এতটা আত্মকেন্দ্রিক হলাম কী করে! আমরা তো এমন ছিলাম না। আমরা ছিলাম সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরোধী সফল এক জাতী। মহান মুক্তিযুদ্ধে এমনও হয়েছে, নিজের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই অথচ প্রতিবেশীর জন্য, চেনা মানুষগুলোর জন্য একটি সুখী সুন্দর বাংলাদেশের জন্য হাসতে হাসতে আমাদের বীর যোদ্ধারা জীবন দিয়ে দিয়েছেন। সেই চেতনার আজ কি তবে সমাপ্তি ঘটেছে ? আজ রাহাত এবং তার পরিবারের এই মর্মান্তিক অবস্থা কি নেহাৎ তাদের একার-ই সমস্যা ? আপনি ভাবছেন কার ছেলে কী করে বেড়াল তা দেখে আমার প্রয়োজন কী? এত সহজ ভাববেন না। আজ রাহাত নিঃশেষ হয়েছে কাল আপনার ছেলে যে ওদের কবলে পড়বে না তার বিশ্বাস কী? অনেকে বলেন, দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, আমার ছেলেকে এই দেশে রাখব না, বিদেশে পাঠিয়ে দেবো। আপনাদের জন্য বলি এতটা নীচ হলেন কী করে? চোরের মতো পালানো তো এই দেশের মানুষের স্বভাব না। সমস্যাকে সামনে রেখে তার মোকাবিলা করাই তো বাঙালির ইতিহাস।

সর্বনাশা এই ক্রিকেট জুয়া প্রতিদিন দেশের কতো শত কোটি টাকা নষ্ট করছে তার হিসাব কে দেবে? আজ যা ক্ষতি হচ্ছে কাল কি তার চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষতি হবে না? জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এই তরুণেরা একসময় অর্কমন্য অপদার্থ আবর্জনায় পরিণত হবে। তখন এরা কী করবে একবার ভেবে দেখেছেন? এরা না পারবে কোনো চাকরি করতে, না পারবে ব্যবসা করতে। আপনার আমার সমাজের বোঝা হয়েই এরা বেঁচে থাকবে। তখন কি এই জঞ্জাল ইচ্ছে করলেই আপনি ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবেন? আজ এরা কারো শিকার, কাল নিজেরাই হবে শিকারি। এই শিকার আর শিকারির হাত থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় নেই? আমাদের কি কিছুই করার নেই ?

পড়ুন কাঁচের চোখ ১

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test