E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রাজাকার অপশক্তি: কত দূর যেতে চায় ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

২০২৫ সেপ্টেম্বর ০৪ ১৭:৪৪:২৫
রাজাকার অপশক্তি: কত দূর যেতে চায় ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

আবীর আহাদ


বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, লাখো নারীর সম্ভ্রম, কোটি মানুষের দুঃসহ ত্যাগ আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অমিত বীরত্বের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তবুও বিস্ময়করভাবে এ দেশের মাটিতেই এমন একটি শক্তি আজও টিকে আছে, যারা মনেপ্রাণে বাংলাদেশকে স্বীকার করে না। এরা কখনো চাঁদতারা খচিত পাকিস্তানি পতাকার আবেশে, কখনো পাকসারজমিন সাদবাদ জাতীয় সংগীতের মোহে, আবার কখনো ধর্মের আড়ালে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে একই মানসিকতায় সক্রিয় থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে—এই শক্তি আর কতদূর যেতে পারে?

১. স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উৎপত্তি ও মানসিকতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়ানো প্রধান দুটি শক্তি ছিল:- পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর দেশীয় সহযোগী: রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি।

এরা আদর্শগতভাবে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে তারা সরাসরি “পাকিস্তানবিরোধী ষড়যন্ত্র” আখ্যা দিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের মানসিকতা পরিবর্তিত হয়নি। বরং বংশপরম্পরায়, আবালবৃদ্ধবণিতা সবার ভেতরে তারা সেই বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব বাঁচিয়ে রেখেছে।

২. স্বাধীনতার পর পুনরুত্থান

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহাদুর্যোগ ডেকে আনে।হত্যাকারীরা সংবিধানের মূল আদর্শ ধ্বংস করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় পুনর্বাসিত করে।১৯৭৯ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে রাজাকারদের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে বৈধতা দেয়। ১৯৮০-এর দশকে এরশাদ আমলে পাকিস্তানপন্থীরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবেই যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল, তারাই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হয়ে ওঠে।

৩. ২০০১–২০০৬: এক অন্ধকার অধ্যায়

২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। এ সময়- মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নৃশংস নির্যাতন চালানো হয়। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রভাব বাংলাদেশে বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করে।

৪. সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট

আজও স্বাধীনতাবিরোধী আবালবৃদ্ধবণিতাচক্র নানাভাবে সক্রিয়- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর, জাদুঘরে অগ্নিসংযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করছে প্রকাশ্যে। শিক্ষা ও মাদ্রাসার একটি অংশকে ব্যবহার করছে পাকিস্তানপন্থী চিন্তাধারা ছড়াতে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে দুর্বল দেখাতে বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করছে।

৫. এরা কতদূর যেতে চায়?

তাদের লক্ষ্য সুস্পষ্ট—

ক. বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস বিকৃত করা।

খ. মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া।

গ. মুক্তিযোদ্ধা ও জাতির পিতার মর্যাদা ধ্বংস করা।

ঘ. ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে পাকিস্তানি আদর্শে ফিরিয়ে নেওয়া।

ঙ. অতঃপর পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলা।

কিন্তু তারা যতদূর যেতে পারবে, তা নির্ভর করছে- রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, জনগণ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম কতটা সচেতন থাকবে, রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কতটা একতাবদ্ধ থাকবে তার ওপর।

৬. ভবিষ্যতের করণীয়

শিক্ষা ও গবেষণা: মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পাঠ্যপুস্তক ও গবেষণাকে সমৃদ্ধ করা।

আইন ও বিচার: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখা এবং নতুন প্রজন্মের অপরাধপ্রবণ কর্মকাণ্ড আইনের আওতায় আনা।

সামাজিক আন্দোলন: সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শক্তিশালী করা।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা: যে কোনো সরকারকে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন থেকে বিরত থাকা।

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি থেমে নেই, থেমেও থাকবে না। তাদের উদ্দেশ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতিশোধ নেয়া, বাংলাদেশের ভিত্তিকে দুর্বল করা, পাকিস্তানি আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের শত্রু বানানো। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, শেষ পর্যন্ত বাঙালি জনগণ স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার পাশে দাঁড়িয়েছে। তাই স্বাধীনতাবিরোধী আবালবৃদ্ধবণিতাচক্র যতদূর যেতে চায়, যাক না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধপ্রাণ বাঙালি জাতি তাদের প্রতিরোধ করবেই করব।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test