E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভুয়া বিএডধারী প্রধান শিক্ষকের সুপারিশ করে ফেঁসে যাচ্ছেন উপ পরিচালক

২০১৮ জানুয়ারি ৩১ ১৬:১৬:৫৩
ভুয়া বিএডধারী প্রধান শিক্ষকের সুপারিশ করে ফেঁসে যাচ্ছেন উপ পরিচালক

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : জাল-জালিয়াতি মাধ্যমে ভুয়া বিএড সনদদারী বাউফলের সেই প্রধান শিক্ষকের এমপিওভুক্তির সুপারিশ করে ফেঁসে যাচ্ছেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের বরিশালের উপপরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। ওই শিক্ষকের জাল-জালিয়াতির ব্যাপারে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেছিলেন- অভিযোগসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। এমপিওভুক্তির আবেদন বাতিলসহ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার প্রক্রিয়া চলছে।

একাধিক সূত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুসরাত জাবীন বানু’কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল বুঝিয়ে জাল বিএড সনদে এমপিওভুক্তির সুপারিশ করানো হয়। এ ব্যাপারে তার স্বাক্ষরিত নথির ৯৫৪০৫১৭ নাম্বারে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের বরিশাল আঞ্চলিক অফিসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কোন হার্ড কপি বিহীন উপসচিব’র নথিতে কিভাবে উপপরিচালক সুপারিশ করেন তা আমাদের জানা নেই। নথি সূত্রে জানা গেছে, উপসচিব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২)-এর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন। নিয়মানুযায়ী তিনি উপপরিচালককে অবহিত করবেন। কিন্তু উপসচিব’র আদেশ কিভাবে সরাসরি উপপরিচালকের দপ্তরে পৌছে তা নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা শিক্ষক সমাজে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে উপপরিচালক এহেন কাজটি করেছেন। যা দুদকের তদন্তে বেড়িয়ে আসবে থলের বিড়াল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী নওমালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কেএম নাসির উদ্দিন (সবুজ খাঁ) নজিরবিহীন দুর্নীতি জায়েজ করতে আইন-কানুনের মুখে চুনকালি দিয়েছেন। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুসরাত জাবীন বানু’কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল বুঝিয়ে জাল বিএড সনদে এমপিওভুক্তির আবেদন করে ফেঁসে যাওয়া আতঙ্কে দিশা হারিয়ে কথাও বলছেন এলোমেলো। তার কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো সদুত্তোর দিতে না পেরে অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলেন।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এমপিওভুক্তির আবেদনের পর তার বিএড সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ার পর ঘাপটি মেরে থেকে ফের ২০১৭ সালের অক্টোবরে অপকর্ম গোপন করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব নুসরাত জাবীন বানু’কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল বুঝিয়ে এমপিওভুক্তির অনুমোদনের একটি নির্দেশনা জারি করান। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের জেলা শিক্ষা অফিসার, এডি, ডিডি কেউই তা জানেন না। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি নওমালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন তিনি।

অন্ধগলির ফাঁকফোকর দিয়ে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লুটে নিয়ে অনলাইনে এমপিওভুক্তির জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে জেলা শিক্ষা অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রেরণ করেন। জেলা শিক্ষা অফিসার রুহুল আমীন খান উপর্যুক্ত বিষয়ে বর্ণিত শিক্ষকের বিএড ডিগ্রি সঠিক নয় মর্মে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরাবরে অনুলিপি প্রেরণ করেন। যার স্মারক সংখ্যা : জেশিঅ/পটু/৭৩/৪ তারিখ- ২৩ জানুয়ারি ২০১৭। এ সংক্রান্ত সংবাদ জাতীয়, আঞ্চলিক এবং বিভিন্ন অনলাইনে প্রকাশিত হয়।

এ ঘটনায় প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ক্ষোভজনিত তোলপাড় সৃষ্টির পাশাপাশি থমকে যায় নাসির উদ্দিনের এমপিওভুক্তি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এতোকিছুর পরও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দপ্তরের ঘাড়ে দুর্নীতি চাপিয়ে নিজের ফায়দা হাসিল করতে হাল ছাড়েননি ওই শিক্ষক। তার নজিরবিহীন বেপরোয়া দুর্নীতি সর্বমহলে জানাজানি হলেও জাল কাগজপত্র গোপন রেখে সম্প্রতি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পটুয়াখালী জেলা শিক্ষা অফিসের হেডক্লার্ক সুলতান আহমেদ জেলা শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর আলমকে ভুল বুঝিয়ে দুবছর পর এমপিওভুক্তির সুপারিশ করিয়ে নেন।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় শিক্ষক মহল, এলাকাবাসী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সূত্র আরও জানান, জেলা শিক্ষা অফিসার রুহুল আমীন খান কর্তৃক উপপরিচালক বরাবরে প্রেরিত চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারির জেশিঅ/৭৩ নং স্মারকের প্রতিবেদনে কেএম নাসির উদ্দিন বাউফল উপজেলার বজলুর রহমান ফাউন্ডেশন গার্লস সেমিনারির সহকারি শিক্ষক থাকাকালিন ২০০৬ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পটুয়াখালীর বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন (রোল নং-৬১২৬৭১)। এরপর ২০০৭ ও ২০০৮ সালে আরও দু’বার একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএড প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন।

দুই বছর পর ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে পুনরায় বিএড প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির কাছে ১ বছরের ছুটির আবেদন করেন। ম্যানেজিং কমিটি ২০১০ সালের জুন থেকে ২০১১ সালের মে মাস পর্যন্ত ১ বছরের ছুটি অনুমোদন দেন। এছাড়া আরও ৬ মাস ছুটি মঞ্জুর করা হয়। ওইবারও তিনি বিএড প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। কিছুদিন পর সাভারের গণকবাড়ির দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে বিএড প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হওয়ার একটি সনদপত্র বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেন কেএম নাসির উদ্দিন। ওই আজগুবি সনদপ্রাপ্তির প্রশিক্ষণের জন্য ছুটির সন ও পাসের সনদ নিয়ে ওই সময় বির্তকের সৃষ্টি হয়। শিক্ষক মহলসহ জনমনে প্রশ্ন জাগে একই সময় তিনি কীভাবে দু’বার বিএড প্রশিক্ষণে অংশ নিলেন এবং একটিতে অকৃতকার্য আরেকটিতে হলেন কৃতকার্য। এছাড়া যদি কৃতকার্য হয়ে থাকেন তাহলে জাল সনদ কেনো দিলেন?

প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নয়ছয় বুঝিয়ে কেএম নাসির উদ্দিন ওই জালসনদ দিয়ে ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি বাউফলের সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থীর বিদ্যাপীঠ নওমালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লুফে নিয়ে অনলাইনে এমপিওভুক্তির জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে জেলা শিক্ষা অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রেরণ করেন।

ইতোমধ্যে কেএম নাসির উদ্দিনের বিএড প্রশিক্ষণের ভূয়াসনদ সম্পর্কে দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ একাধিক ব্যক্তি জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে প্রমাণাদিসহ অভিযোগ দাখিল করেন। সম্প্রতি এ ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে বাউফলসহ বরিশাল বিভাগজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

এ ব্যাপারে কেএম নাসির উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বিএড ডিগ্রির সনদপত্র জাল নয়। ২০০৬, ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএড প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পরেও ২০০৮ সালেই কিভাবে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসের সনদ লাভ করলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. মমিন উদ্দিন তাকে ফাঁসানোর জন্য রেজুলেশন জালিয়াতি করছেন। কিন্তু তার স্ত্রী মোসা. ফাহমিদা বেগম ওই কমিটির সদস্য এবং ওই রেজুলেশনে তার স্বাক্ষর রয়েছে উল্লেখ করলে তিনি ‘‘থ’’ খেয়ে যান।

(টিবি/এসপি/জানুয়ারি ৩১, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test