E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শ্যামনগরে নতুন করে হামলার আশঙ্কায় ঘরছাড়া ছয় হিন্দু পরিবার

২০১৬ মার্চ ১৬ ২১:০৯:৪৬
শ্যামনগরে নতুন করে হামলার আশঙ্কায় ঘরছাড়া ছয় হিন্দু পরিবার

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বিএনপি’র প্রার্থীর পক্ষে আগামি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দেবে এমন প্রচারে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রার্থীর লোকজন ১০টি হিন্দু পরিবারসহ ১১টি বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। এ সময় তারা সাতটি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করে বিচালী গাদায় আগুন দিয়েছে। প্রতিবাদ করায় পিটিয়ে জখম করা হয়েছে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ১৪জনকে। ভাঙচুর করা হয়েছে ১২টি মোটর সাইকেল।

মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামের হাসারচক পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নতুন করে হামলার আশঙ্কায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ছয়টি হিন্দু পরিবারের সদস্যরা।

আহতরা হলেন, শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামের হাসারচকপাড়ার মৃত শুশীল মণ্ডলের ছেলে সঞ্জয় কুমার মণ্ডল (৪০), তার মেঝ ভাই উত্তম কুমার মণ্ডল (৪৫), তার স্ত্রী পাপিয়া মণ্ডল (৩২), তাদের ছোট ভাই অঞ্জন মণ্ডলের স্ত্রী লক্ষী রাণী মণ্ডল (২৮), তার মেয়ে মায়া রাণী মণ্ডল (৪), একই গ্রামের উদয় মিস্ত্রীর ছেলে অরুণ কুমার মিস্ত্রী (৫৫), গোপাল মিস্ত্রীর ছেলে পরিমল কুমার মিস্ত্রী (৪৭), গৌর মিস্ত্রীর ছেলে কমলেশ মিস্ত্রী(৩০), অনিল মিস্ত্রীর ছেলে মণীন্দ্র নাথ মিস্ত্রী (৪৬), শুভেন্দু মিস্ত্রীর ছেলে প্রশান্ত মিস্ত্রী (৩৭), বংশীপুর গ্রামের আব্দুল ওহাব গাজীর ছেলে আলম হোসেন (২৭), তার বাবা ওহাব গাজী (৫৭), লস্কর হাজীর ছেলে আব্দুল হামিদ গাজী (৬৫) ও ধুমঘাট গ্রামের আবু দাউদ গাজী (৫৫)।

হাসারচক পাড়ার সঞ্জয় কুমার মণ্ডল জানান, তারা বংশপরম্পরায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তবে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের অত্যাচারে তারা যার পর নেই নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। আগামি ২২ মার্চ ইউপি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপি প্রার্থী জিএম ছাদিকুর রহমানের লোকজন তাদের বাড়িতে কয়েকবার ভোট চাইতে আসে। নিজেদের দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শোকর আলী ভাবতে শুরু করেন যেে হাসারচকের অধিকাংশ হিন্দু পরিবার ধানের শীষে ভোট দেবে।

সঞ্জয় কুমার মণ্ডল আরো জানান, মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে ধুমঘাট ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলসহ ১০/১২জন হাতে লাঠি নিয়ে তার মেঝ ভাই উত্তম মণ্ডলের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এ সময় তারা নৌকায় ভোট না দিলে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে বউদি পাপিয়া মণ্ডলের গলা ধাক্কা দিয়ে ঘরের মেঝেতে ফেলে দেয়। বাধা দেওয়ায় ভাই উত্তম মণ্ডলকে মারপিট করা হয়। এ সময় ভাঙচুর করা হয় ভাইয়ের বসতঘর ও রান্না ঘর। এর কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়েং নির্বাচনে অংশ নেওয়া শোকর আলীর ভাই জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে ৭০/৮০জন জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে ছোট ভাই অঞ্জন মণ্ডলের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এ সময় অঞ্জনের স্ত্রী লক্ষী রাণী মণ্ডলকে মারপিট করে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। পিটিয়ে জখম করা হয় তার শিশু সন্তান মায়া রানী মণ্ডলকে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় অঞ্জনের বিচালী গাদায়। পরে ওইসব সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তার (সঞ্জয়) বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে লক্ষ্য করে বাঁশের লাঠি ছুঁড়ে মারা হয়।

কমলেশ মিস্ত্রী জানান, সঞ্জয় মণ্ডলের বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে সন্ত্রাসীরা তাকে রাস্তার উপর পেয়ে বেধড়ক মারপিট করে। ধানের শীষে ভোট দেওয়ার সাধ মিটিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। ‘এ দেশে যতদিন থাকবি- ততদিন নৌকায় ভোট দিবি’ এসব কথা বলতে বলতে তারা সামনে এগিয়ে যায়। এরপর একে একে তারা অরুণ মিস্ত্রী ও পরিমল মিস্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়। ভাঙচুরে বাধা দেওয়ায় তারা লাঠি দিয়ে অরুণ মিস্ত্রীর মাথা ফাঠিয়ে দেয়। পিটিয়ে জখম করে পরিমল মিস্ত্রীকে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর শেষে লুটপাট করা হয় ওইসব বাড়িতে। পরে তারা মনীন্দ্রনাথ মিস্ত্রী ও প্রশান্ত মিস্ত্রীর বাড়িতে ঢুকে হামলা চালায়। ‘মালায়নের বাচ্চা, ভোট দিবি ধানের শীষে, এত সাহস তোদের দিয়েছে কে, হয় নৌকায় ভোট দিবি নয়তো দেশ ছাড়বি’ এসব কথা বলতে বলতে তারা প্রশান্তকে পিটিয়ে জখম করে। মণীন্দ্র নাথ মিস্ত্রীর ডান হাতের তিনটি আঙুল লোহার রড দিয়ে ফাটিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে গেলে বাড়ি ফিরতে পারবি না বলায় তারা স্থানীয় গ্রাম ডাক্তার তাপস মণ্ডলের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন। নতুন করে হামলার আশঙ্কায় তিনি (সঞ্জয়), ভাই উত্তম, প্রশান্ত, অরুণ, পরিমল ও মণীন্দ্র এর পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে শোকর আলীর সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

এদিকে বংশীপুর গ্রামের বিএনপি কর্মী আলম হোসেন জানান, নির্বাচনী প্রচারণা শেষে মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে দলীয় প্রার্থী ছাদেকুর রহমানের একটি ব্যানার ও কয়েকটি হ্যান্ড বিলসহ তিনি ধুমঘাট থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে নৌকা মার্কার লোকজন হাসার চকে তার মোটর সাইকেল লক্ষ্য করে ধাওয়া করে। জীবন বাঁচাতে তিনি দাউদ গাজীর বাড়িতে ঢুকে পড়লে তারাও সেখানে হামলা চালায়। দাউদ গাজীকে তারা মারপিট করে তাকে (আলম) টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে টেনে বের করে রাস্তায় আনে। সেখানে তাকে এলোপাথাড়ি পিটিয়ে জখম করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় তার মোটর সাইকেলটি। খবর পেয়ে বাবা ওহাব গাজী ও চাচা হামিদ গাজী তাকে রক্ষার চেষ্টা করলে তাদেরকে ও পিটিয়ে জখম করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় তাদের বহনকারি দু’টি মোটর সাইকেল। এরপর তারা হাসার চকের কয়েকটি বাড়ির সামনে থাকা ধানের শীষের প্রচারণায় ব্যবহৃত নয়টি মোটর সাইকেল ও দু’টি ইঞ্জিনভ্যান ভাঙচুর করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এসর ঘটনা পুলিশকে জানালেও তাদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। পুলিশ আওয়ামী লীগের ক্যাডার হিসেবে কাজ করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। রাত ১টার দিকে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।

ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জিএম সাদেকুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শোকর আলীর সমর্থক গোলাম মোস্তাফা বাংলা ভাই, আব্দুল কাদের, রুবেল,জাহিদ, রায়হান,শাহজাহান,আনিসুর,এবাদুলসহ ৫০/৬০জন হাসারচকে তার সমর্থক ১০টি হিন্দু পরিবারসহ ১১টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। আগুন দেওয়া হয়েছে বিচালী গাদায়। ভাঙচরি করার পর কয়েকটি মোটর সাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ভয়ে এলাকাছাড়া ১০টি’র বেশি হিন্দু পরিবার। তিনি এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাচন অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

তবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শোকর আলি জানান, ভোটে হেরে যাবেন জেনে সাদেকুর রহমান নতুন নাটক করছে।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) এনামুল হক জানান, হামলার খবর পেয়ে উপরিদর্শক আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। গতকাল বুধবার সকালে তিনিসহ পুলিশ , উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনারের লোকজন ঘটনাস্থলে আসেন। পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এ নিয়ে গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়নি।


(আরএনকে/এস/মার্চ১৬,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test