E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাষ্ট্র ও ধর্ম : বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর শেষার্ধে

২০২২ মার্চ ০৮ ১৫:২৬:৪৫
রাষ্ট্র ও ধর্ম : বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর শেষার্ধে

রণেশ মৈত্র


রাষ্ট্র ও ধর্ম- এ দুটি বিষয়ের পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবনার উৎপত্তি ১৯৪৭ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে ঘটেছিল। অন্তত: বাঙালির মানচিত্তে। পাঞ্জাবের তেমনটি ঘটেছিল- উর্দু সাহিত্য অনুবাদ পাঠ করে এ খবরটি জানা গিয়েছিল। খন্ডিত্য অবিভক্ত ভারতবর্ষের বহু সংখ্যক প্রদেশের মধ্যে বাংলা ও পাঞ্জাব এই দুটি প্রদেশই পাকিস্তান সৃষ্টিকালে ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্তির কবলে পড়েছিল। আবার এই দুটি প্রদেশই ছিল ভারতবর্ষের উচ্চ আসনে।

ধর্মের বিত্তিতে অতীত থেকে আজ পর্য্যন্ত পৃথিবীর কোথাও কোন রাষ্ট্রের নির্মাণের খবর আমার জানা নেই। কিন্তু তা প্রত্যক্ষ করতে হলো নিজ মাতৃভূমিতেই। এই বিভক্তিকামীরা বিভক্তির সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সেদিন যা যা বলেছিলেন কম বেশি তা আজও মনে আছে। সেগুলি হলো: ১. হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। তাই দুই জাতির দুটি পৃথক রাষ্ট্র থাকতে হবে; ২. ভারতবর্ষ জুড়ে দফায় দফায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল তা বন্ধ করতে হলে ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার বিকল্প নেই; তিন. হিন্দুরা মুসলমানদেরকে যেভাবে ঘৃনা করে, যেভাবে মুসলমানদেরকে নানাভাবে বঞ্চিত করে তার অবসান ঘটাতেও ধর্মেও ভিত্তিতে দেশ বিভাগে অপরিহার্য্য। তখনকার মত এ যুক্তিগুলি সঠিক কি বেঠিক তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা না করেই একদিকে ধর্মীয় আবেগ অপরদিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষক্তি পরিবেশ মানুষকে এতটাই বিচলিত করে তুলেছিল সে সমস্যাগুলির তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে দেশ বিভাগ সবাই মেনে নিয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।

পরবর্তীতে তবে বেশি দিন পরে নয়, অভিজ্ঞতা যা দাঁড়লো-বিশেষ করে পাকিস্তানের বাঙালিদের তাতে ঐ ধর্মবিশ্বাসীর জন্য এক রাষ্ট্র এটি অবাস্তব এবং সমগ্র পৃথিবীতে কোথাও এমন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই বা এমন তত্ত্ব (দ্বিজাতিতত্ব বলে এ দেশে পরিচিত) কোথাও কেউ দাবী বা প্রচারও করছেন না। এক ধর্ম বিশ্ববাসীর জন্য এক রাষ্ট্র এই তত্ব মানলে মুসলমানদের সারা পৃথিবীতে এতগুলি রাষ্ট্র যেমন পাকিস্তান, আফগান্তিন, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, তুরস্ক এবং আরও অনেকগুলি দেশ মিলে তো একটি মাত্র রাষ্ট্র হওয়ার কথা।

অনুরূপভাবে, ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি মিলে খৃষ্টানদের একটি মাত্র দেশ থাকার কথা। তেমনি ভারত ও নেপাল মিলে হিন্দু রাষ্ট্র, প্রাচ্যেও কিছু রাষ্ট্র মিলে একটি মাত্র বৌদ্ধ রাষ্ট, প্রভৃতি হওয়ার কথা। কিন্তু তা তো হয়নি তেমন ভাবনাও কারও মগজে ঢুকেনি।

৩. হিন্দুরা মুসলমানদের উপর নির্য্যাতন করেছে এটা আংশিক সত্য, পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়। করেছে হিন্দু জোতদার-জিমদারেরাই শুধু অন্যে বা নয়। তাদের প্রজা- সে মুসলমানই হোক বা হিন্দুই হোক সকলেই তাদের হাতে নির্য্যাতিত হয়েছে। আবার মুসলমান জমিদারও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকল প্রজাকেই নির্য্যাতন করেছে। ইতিহাস এমনটাই বলে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই কিছু ঊীপবঢ়ঃরড়হ ও ছিল। তাই সমস্ত কৃষক সমাজ কি হিন্দু কৃষক কি মুসলিম কৃষক সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে দাবী তুলেছিলেন “জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ চাই”। কেউ বলেনি, “হিন্দু জমিদারীর উচ্ছদ হোক” বা “মুসলিম জমিদারী উচ্ছেদ হোক। সুতরাং এই যুক্তিতেও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ কোথাও ঘটেনি যদিও এমন অত্যাচার নির্য্যাতন জমিদারদের পক্ষ থেকে পৃথিবীর অনেক দেশেই চালু ছিল। দাস প্রথার কথাও নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি আমরা। চার. অতীতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও দেশ বিভক্তির কারণ হতে পারে না। কারণ পৃথিবীর সকল দেশেই কোন না কোন ধর্ম বিশ্বাসী দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আছেন, আবার সংখ্যালঘুও আছেন। তাঁদের মধ্যে কোন প্রশ্নে বিরোধ নেই তাও সত্য নয়। নানা প্রশ্নে ভিন্নমত বা মত বিরোধতার কারণে তাঁরা কিন্তু কেউই দেশ বিভাগ চাননি বরং দেশের প্রশ্নে সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকাই প্রয়োজন এমন কথাই বলেছেন।

“সকল মুসলামন ভাই ভাই” বলে যে শ্লোগান অনেক সময় উচ্চারিত হতে দেখা বা শুনা যায় স্বার্থেও ব্যাপারে কিন্তু কোথাও তেমনটি ঘটে না। উদাহরণ হিসেবে হিন্দু চোর কিন্তু হিন্দু বাড়ী বাদ দিয়ে মুসলিম বাড়ীতে শুধু চুরি করে না দিব্যি তারা হিন্দু বাড়ীতেও চুরি করে। অনুরূপভাবে একজন মুসলিম চোরও হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবার বাড়ীতেই চুরি করে। তেমনি আবার একজন মুসলিম সৎ এবং ভাল লোক হিন্দু মুসলিম সবার প্রতিই সমভাবে সদাচরণ করেন ভালো হিন্দুও অনুরূপভাবে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলের সাথেই অনুরূপ সদাচরণ করেন। আর দুটি উদাহরণ দেব;
এক. একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাল শিক্ষককে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তাঁর সকল ছাত্র ছাত্রী সমর্থন করে বা একজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী ভাল শিক্ষককে তাঁর সকল ছাত্র ছাত্রী হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে অত্যন্ত সমীহ করে শ্রদ্ধার আসন দিয়ে থাকে। অনুরূপভাবে খারাপ শিক্ষক তা তিনি হিন্দু বা মুসলিম যাই হোন না কেন কোন ছাত্র ছাত্রীই তাঁর প্রশংসা করেন না বা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন না।

এমন ঘটনা দেশ বিভাগের আগেও ঘটেছে পরেও ঘটেছে। তাই মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র দাবীর পেছনে সততা, সদুদ্দেশ্য বা আদর্শ নিষ্ঠতা কোনটাই ছিল না ছিলো হিন্দু ও মুসলিম ধণিক বণিকদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব।

এখানে উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারত বর্ষের প্রধান দুটি সর্বভারতীয় দল ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (যা সংক্ষেপে কংগ্রেস নামে পরিচিত) এবং সর্ব ভারতীয় মুসলিমলীগ (সংক্ষেপে মুসলিমলীগ)। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিলেন জাতীয়তাবাদী হিন্দু ও মুসলিমলীগের নেতৃবৃন্দ যাঁরা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, অনেকে বছরের পর বছর জেল খেটেছেন এবং শত নির্য্যাতন হাসিমুখে বরণ করেছেন। এই দলটির নেতৃত্বে তখন ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং আরও অনেক খ্যাতনামা নেতা যাঁদের নি:স্বার্থ দেশপ্রেম আমাদের উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। যতটুকু আমার জ্ঞানে বুঝি, এরা ছিলেন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সহ অপরাপর সাধারণ জনগোষ্ঠীর নেতা। তাই তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও বিদেশী শোষণের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কিন্তু কংগ্রেসে এঁরাই শুধু নন, ভারতের ধনিক বনিকদের নেতৃত্ব যারা করতেন, দলটির বিশালত্ব ও জনপ্রিয়তা দেখে তাঁরাও অনেকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্থান করে নিয়েছিলে। এই অংশ জেলের ধার ধারেন নি তবে আন্দোলনে সময় সময় মৌখিক সমর্থন জানিয়েছেন নিজেদের স্বাধীনতা বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক চেহারা মানুষের সামনে লুকিয়ে রাখতে কিন্তু গোপনে এরা বৃটিশ সাম্প্রজ্যবাদের যোগসাজসে ভারত বিভক্তির পক্ষে থাকতেন।

দ্বিতীয় মুসলিমলীগের একক নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেওে বাংলা একে ফজলুল হক, নাজিম উদ্দিন। মোটা দাগে এরা সবাই ইংরেজদের যোগসাজসে মুসলিম পঁজিবাদী ও সামন্তবাদীদের ধারক বাহক হিসেবে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র চেয়েছিলেন যার নাম তাঁরাই দিয়েছিলেন পাকিস্তান। কংগ্রেস এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করে।

তখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে অপরিহার্য্য করে তোলার জন্য বাংলাসহ ভারতের নানা অঞ্চলে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি কওে মারাত্মক এক সাম্প্রদায়িক আবহ গড়ে তোলে। মহাত্মা গান্ধী যেখানেই দাঙ্গা বেধেছে সেখানেই ছুটে যেতেন শান্তি ও সম্প্রতির আবেদন নিয়ে। ম্যাজিকের মত ফলও ফলতো। আবার তারা দাঙ্গা বাধাতো অন্য কতিপয় অঞ্চলে। গান্ধীজী সেখানেই ছুটতে খবর পাওয়া মাত্র। তবে এ সকল দাঙ্গার মূলে মুসলিম একই ছিল তা নয়। এরম মদদাতা ইংরেজ শাসকেরা এবং কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক অংশও। মুসলিমলীগ পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র চেয়েছিলেন মুসলিম ধনিক বনিকদের ব্যবসায়ী স্বার্থে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন বিশেষ করে বোম্বে শহওে, বিস্তর কোটিপতি মুসলিম ব্যবসায়ী ছিলেন ছিলেন ভারতের অপরাপর অঞ্চলেরও।

কিন্তু ভারতবর্ষেও বিশাল বাজাওে হিন্দু ধনিকশ্রেণীর সাথে ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় এটে ওঠা কঠিন। এই বিবেচনায় তাঁরা চাইলেন একটি রুদ্ধ বাজার এবং সেটা একমাত্র সম্ভব হতে পাওে, যদি মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হয়। নানা চেষ্টা অপচেষ্টার পর সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা গান্ধীকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে দাঙ্গামুক্ত দেশ চাইলে মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবী মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তা না মানলে গোটা ভারতবর্ষে রক্ত দাঙ্গা বইতেই থাকবে। গান্ধীজী অবশেষে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও সায় দিলেন। মওলানা আবুল কালাম আজাদ সহ কংগ্রেসের মুসলিম নেতারা পাকিস্তান সৃষ্টিতে ঘোর আপত্তি এবং অখন্ড ভারতবর্ষের দাবী পুনরুক্তি করলেন সাম্প্রদায়িক হিন্দু কংগ্রেসেরা মহাত্মা গান্ধীকে বুঝাতে সক্ষম হলেও যে দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে হলে পাকিস্তান দাবী মেনে নেওয়ার বিকল্প নেই। দান্ধীজী ইচ্ছার বিরুদ্ধে সায় দিতে বাধ্য হলেন, চক্রান্ত সফল হলো। এক সেকেন্ডের জন্য স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীদাররা জেল না খেটেই পেয়ে গেলেন মুসলমানদের স্বাধীন দেশ পকিস্তান। তারিখটা ছিল ১৯৪৭ এর ১৪ আগষ্ট।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test