E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গৃহপরিচারিকাকে নির্যাতনে স্বামী-স্ত্রী গ্রেফতার

২০১৭ ডিসেম্বর ০৫ ১৯:২৮:৫২
গৃহপরিচারিকাকে নির্যাতনে স্বামী-স্ত্রী গ্রেফতার

চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি : পাবনার চাটমোহরে রবিবার রাতে পৌর শহরের ছোট শালিখা মহল্লার একটি বাড়ি থেকে নির্যাতনের শিকার গৃহবন্দি অবস্থায় অসুস্থ উদ্ধারকৃত গৃহপরিচারিকা ৫ বছর পর বাবা-মায়ের কোলে ফিরেছে। তার চোখে মুখে আতংক কেটে এখন হাসি ফুটেছে। বর্ণনা করছে নির্যাতনের নানা কাহিনী।

এ ঘটনার পর সোমবার রাতে গৃহপরিচারিকা সুমির মা আঞ্জুয়ারা খাতুন বাদি হয়ে চাটমোহর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং ৫।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) মো. শফিকুল ইসলাম সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে রাত সাড়ে ৮টার দিকে অভিযুক্ত দম্পতি আব্দুস সোবহান বিচ্ছু ও ফেরদৌসি বেগম লিলিকে গ্রেফতার করেছে। মঙ্গলবার সকালে তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত জেলহাজতে পাঠিয়েছে। সুমি ও তার পরিবার নির্যাতনকারী দম্পতির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

জানা যায়, রবিবার রাত ৮টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে থানার ওসি আহসান হাবীবের নির্দেশে এসআই শেখ আব্দুল লতিফ এবং এএসআই মোস্তাফিজুর রহমান ছোটশালিখা (কালিনগর) মহল্ল¬ার আব্দুস সোবাহান ওরফে বিচ্ছু’র বাড়িতে দু’দফা অভিযান চালিয়ে সুমি খাতুন (১৪) নামের শারীরিক প্রতিবন্ধী ওই গৃহকর্মীকে উদ্ধার করেন। উদ্ধারকৃত সুমি পার্শ্ববর্তী গুরুদাসপুর উপজেলার বিল বিয়াসপুর গ্রামের শফিকুল ইসলামের মেয়ে। তার মায়ের নাম আঞ্জুয়ারা বেগম। তার মামা কাজের জন্য তাকে প্রায় ৫ বছর আগে গৃহকর্মী হিসেবে চাটমোহরে ওই বাড়িতে রেখে যান।

এদিকে বন্দি দশা থেকে উদ্ধার পাওয়া অসুস্থ অসহায় গৃহকর্মী সুমি খাতুন পুলিশের প্রচেষ্টায় দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর পর জন্মদাতা পিতা, গর্ভধারিনী মা, চাচা-চাচী, মামা-মামীসহ আত্মীয়-স্বজনদের পাশে পেয়ে আবেগাপ্লুত। প্রিয়জনদের পাশে পেয়ে সুমি তার গৃহকর্তা দম্পতি কর্তৃক দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতনের নিষ্ঠুর কাহিনী প্রকাশ করছে। যে কাহিনী হার মানিয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও।

সুমি’র চিকিৎসা চলছে চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দীর্ঘ বছর পর ইচ্ছামত খাবার খেতে পারছে সে। দেহের শক্তি এবং মনের সাহস ফিরে পাওয়ায় কথা বলছে হাসি মুখে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সাংবাদিকদের সুমি জানায়, “কাইল (রোববার দিবাগত রাতে) আপনাদেক (পুলিশ ও সাংবাদিক) দেখি ভয় পাইছিল্যাম। ওদেক বাঁচানোর জন্যি মিথ্যা কথা কইছিল্যাম। মিথ্যা না কলি ওরা আমাক আবার মাইরতো।”

পাশের বিছানার রোগী এবং হাসপাতালে অবস্থানরত সকলের তথ্যানুযায়ী সোমবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে গৃহকর্তা আব্দুস সোবাহান বিচ্ছু, গৃহকত্রী ফেরদৌসি আক্তার লিলি আদর ভরা কন্ঠে চোখের জল ফেলে সুমিকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।

রবিবার গৃহকর্মী সুমিকে উদ্ধারের পর পুলিশ প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গৃহকর্তা আব্দুস সোবাহান বিচ্ছু, গৃহকর্ত্রী ফেরদৌসি আক্তার লিলি ও তাদের ছেলে ফজলে রোহানকে থানায় নিয়ে আসেন। তবে মেয়েটি তাৎক্ষনিক কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না করায়, মুচলেকা স্বাক্ষরের মাধ্যমে রাতেই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

এর আগে থানায় এক প্রেসব্রিফিং করেন সিনিয়র এএসপি (চাটমোহর সার্কেল) তাপস কুমার পাল ও অফিসার ইনচার্জ (প্রশাসন) এস এম আহসান হাবীব। ওসি সাংবাদিকদের বলেন, মেয়েটি অসুস্থ। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তার মা-বাবা সোমবার রাতে চাটমোহরে আসার পর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

গৃহকর্মী সুমি জানান, তার মামা তাকে ওই বাড়িতে রেখে গেছে প্রায় ৩ বছর আগে। তবে এলাকার লোকজন জানান, ৫/৬ বছর আগে মেয়েটিকে আনা হয়েছে। কখনও বাইরে বের হতে দেওয়া হতো না তাকে। খাবার দেওয়া হতো যৎসামান্য। টয়লেটে বন্দি করে রাখা হতো।

ওসি বলেন, গৃহকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে কোন অভিযোগ না থাকায় মুচলেকায় তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। সোমবার গৃহকর্মী সুমিকে চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তার মা-বাবা ঢাকা থেকে রাতেই চাটমোহরে আসেন। তার মা আঞ্জুয়ারা খাতুন চাটমোহর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামী দম্পতিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এদিকে সোমবার সকালে কিছুটা সুস্থ হলে সাংবাদিকদের নির্যাতনের বর্ণনা দেয় সুমি। সে সাংবাদিকদের কাছে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আমাকে তারা মারপিট করতো, খাবার কম দিত। বাবা-মার সাথে কথা বলতে দিত না, বাড়ির বাইরে বের হতে দিত না। ওরা মানুষ না, অমানুষ; আমি তাদের বিচার চাইনা; ওদের বিচার আল্লাহ করবেন।’

অপরদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চাটমোহর উপজেলা ও পৌর শাখা যৌথভাবে অসুস্থ সুমি’র চিকিৎসা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে পুলিশি হেফাজতে অসুস্থ অসহায় সুমি’র চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চাটমোহর উপজেলা শাখা’র সভাপতি সাংবাদিক কে. এম. বেলাল হোসেন স্বপন বলেন, আমরা অসুস্থ গৃহকর্মী সুমিকে উদ্ধারে পুলিশের ভূমিকাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা পুরো ঘটনাটি পর্যবেক্ষণে রেখেছি। বর্তমানে আমরা অসুস্থ সুমির চিকিৎসাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। মানবাধিকার কমিশন নির্যাতিতের পক্ষে আইনি লড়াই চালাতে প্রস্তুত রয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে থানায় মামলা হয়েছে। আসামীদের গ্রেফতার করে মঙ্গলবার আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরন করা হয়েছে। মেয়েটিকে তার বাবা-মায়ের জিম্মায় দেয়া হয়েছে।

(এলএইচএম/এসপি/ডিসেম্বর ০৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test