E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী দৃষ্টিপাত সম্পাদকসহ ৬ আসামীর বিচার থমকে গেছে

২০২০ নভেম্বর ১৬ ১৯:০৯:৪৬
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী দৃষ্টিপাত সম্পাদকসহ ৬ আসামীর বিচার থমকে গেছে

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে হুজুরে কেবালা নাটক মঞ্চস্থকালে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে ২৯ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক দৃষ্টিপাতের ভিত্তিহীন খবর প্রকাশিত হয়। এ মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে বিএনপি নেতা নুরুজ্জামান পাড় কোন প্রকার সম্পৃক্ততা ছাড়াই সহকারি শিক্ষিকা মিতা রানী বালাকে ৩০ মার্চ দুপুর ১২টায় বাড়ি থেকে মোটর সাইকেলে তুলে এনে পুলিশের হাতে তুলে দেন। তাকে পাঠানো হয় জেল হাজতে।

পরদিন কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাপা নেতা মোশাররফ হোসেন, সাবেক চেয়ারম্যান আনছার আলী, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের হেলালী ও জুলফিকার সাঁফুই এর নেতৃত্বে আসা মিছিলের মৌলবাদি মুসলিমরা মিতা রানী বালার বাড়ি ঘর লুটপাট ও ভাঙচুর শেষে সকালে ও বিকেলে দু’দফায় প্রেট্রাল ঢেলে আগুণ লাগিয়ে দেয়। আগুণে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গান পাউডার। ছোট ছেলে অনির্বানকে আগুনে ছুুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয় । মামলা থেকে অব্যহতি পেলে ও মিতা ঘটনার সাড়ে আট বছর পরও বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই যন্ত্রনা। দু’সন্তান, স্বামী ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে চলছে তার কঠিন জীবন সংগ্রাম। পুড়ে যাওয়া বাড়ির গ্রীলগুলো যন্ত্রণা দিলেও টাকার অভাবে সংস্কার করতে পারেননি। একইভাবে একই গ্রামের লক্ষীপদ মণ্ডলের বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ফতেপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ।

ফতেপুরের ঘটনার জের ধরে ওই বছরের পহেলা এপ্রিল পুড়িয়ে দেওয়া হয় চাকদহ গ্রামের আটটি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি। লুটপাট করা হয় তাদের যথাসর্বস্ব। কল্যানী সরদার চোখের সামনে তার তিন ছেলের সর্বস্ব লুটপাট করার পর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে দেখেছেন। দেখেছেন এক পুত্রবধুকে বিচালী গাদার মধ্যে নিয়ে ধর্ষণ করতে। এখন তিনি পূূর্ণ পাগল। ছেলেরা কায়িক পরিশ্রম করে আবারো নির্মাণ করার চেষ্টা করছেন বসত ঘর। পাশেই ছেলের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখা বৃদ্ধা অরুনা সরদার ২০১৭ সালে মারা গেছেন। সাত বছর পর ঘর সংস্কারের উদ্যোগ নেন শ্যামাপদ সরদার।

সোমবার সকালে ফতেপুর ও চাকদাহ গ্রামে গেলে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ ও পহেলা এপ্রিলের মুসিলম মৌলবাদের ভয়াবহ স্মৃতি চারণা করতে যেয়ে আতকে ওঠেন মিতা রানী বালা ও কল্যানী সরদারের ছেলে বিশ্বজিৎ সরদার। এ সময় ছল ছল করছিল তাদের চোখগুলো। কল্যাণী সরদার বকছিলেন পাগলের প্রলাপ।

ফতেপুর ও চাকদাহের ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি হিন্দু পরিবারের সদস্যরা জানান, পাঁচটির মধ্যে একটি মামলার বাদি বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার চার্জশীটভুক্ত দৃষ্টিপাত পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে অভিযোগপত্র দায়েরর আড়াই বছর পর আদালতে নারাজি দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও ওই তথ্য গোপন করে কুখ্যাত শিবির ক্যাডার মিজানুর রহমানের হাইকোর্টে স্থগিত করে রাখা মামলা খারিজ হয়ে গেলেও সুপ্রিম কোর্টে রিভিশনের নামে নামমাত্র কাগজপত্র জমা দিয়ে মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। আগামিকাল মঙ্গলবার ধার্য দিন। তবে মামলার বিচার বিলম্বিত করতে নেপথ্যে সর্বনাশা দৃষ্টিপাত কর্তৃপক্ষের হয়ে দু’জন সাংসদ ,একজন সাবেক পিপি, কয়েকজন দাপুটে সাংবাদিকসহ কয়েকজন রাজনীতিবিদের হাত রয়েছে।

তারা আরো জানান, যে দৃষ্টিপাত পত্রিকার কারণে চাকদাহ ও ফতেপুরের ১২টি হিন্দু পরিবারসহ ১৫টি পরিবারের বসত বাড়ি, ঠাকুর ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে ছাঁই করে দেওয়া হলো তারা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।সেই দৃষ্টিপাত পত্রিকা সম্পাদক জিএম নূর ইসলামের নেতৃত্বে প্রেসক্লাব জবরদখল করা ও প্রেসক্লাবের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার কথা ও বিভিন্ন পত্রিকায় তাকে শুভেচ্ছা দেওয়ার ছবি ছাপা হচ্ছে। আর যারা সর্বস্ব হারিয়েছে তাদের জীবন চলছে দুর্বিসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে। শিক্ষক, ছাত্র ও গল্প থেকে নাটকে রুপান্তরকারি মীর শাহীন এর মামলা খালাস হয়ে গেলেও অপর চারটি মামলা চলছে মন্থর গতিতে। দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লা, তৎকালিন বার্তা সম্পাদক ডিএম কামরুল ইসলাম, দক্ষিণ শ্রীপুর প্রতিনিধি অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার মিজানুর রহমান, ফতেপুরের আল আমিন তরফদার ও যুবলীগ নেতা নীলকণ্ঠপুর গ্রামের মামুনর রশীদ মিন্টু ওই মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখিত আসামী হওয়ার পরও তাদের অভিযোগপত্র আদালতে আজো গৃহীত হয়নি।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু ও সাবেক অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. নিজামউদ্দিন বলেন, ২০০২ সালের কলারোয়ায় শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা মামলাটি চার্জশীটে এক নাবালক আসামী রাকিবুর রহমানের নাম থাকায় হাইকোর্টে স্থগিত করে আসামীপক্ষ। ওই মামলা শুনানী শেষে গত ২১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট ক্রিমিনাল মিস কেস খারিজ করে দিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়। ওই আদেশের বিরুদ্ধে আসামীপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিল করলে চেম্বার জজ তা অনুমোদন করে আগামি ৪ জানুয়ারি শুনানীর জন্য দিন দিয়েছে মর্মে আসামীপক্ষ গত ১০ নভেম্বর মুখ্য বিচারিক হাকিমকে অবহিত করেন। এরপরও বিচারক ওই মামলা শুনানীর জন্য আসামীপক্ষের আইনজীবীদের বলেন।

একপর্যায়ে আগামিকাল ১৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আদেশের সত্যায়িত কপি আদালতে উপস্থাপন করার পাশাপাশি সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। অথচ ফতেপুরের সহিংসতার ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহ আাইনের মামলায় চার্জশীট হলেও দু’ বছর আগে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ খারিজ হওয়ার পর আসামী মিজানুর রহমানের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে নামমাত্র লিভ টু আপিল করায় কোন আদেশ ছাড়াই নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রম থমকে গেছে। আসামীপক্ষ যদি নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত সংক্রান্ত কোন আদেশ না আনতে পারে তাহলে নিম্ন আদালতে মামলা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিক হওয়া উচিত। একইভাবে একই গ্রামের, একই ইউনিয়নের বা ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ না হওয়ার পরও অভিযোগপত্র দাখিলের আড়াই বছর পর বাদি খলিলুর রহমানের নারাজির আবেদন শুনানী করে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রখ্যাত নাট্যকার আবু আল মুনসুৃরের হুজুরে কেবালা গল্প অবলম্বনে মঞ্চস্ত হয় নাটক। নাটকের দ্বিতীয় পর্বে যুবলীগ নেতা মামুনার রশিদ মিণ্টু কুখ্যাত হরিণ শিকারী সাত্তার মোড়লের কথামত মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে মর্মে গুজব ছড়ায়। দৃষ্টিপাতের দক্ষিণ শ্রীপুর প্রতিনিধি অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার ফতেপুরর মিজানুর রহমান ২৯ মার্চের পত্রিকায় প্রকাশ করে। ফতেপুর ও চাকদাহে সহিংসতার সকল ঘটনায় ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল দায়েরকৃত চারটি মামলায় ৯৪ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা দু’ হাজার ২০০ লোককে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক লস্কর জায়াদুল হককে বাগেরহাটে স্ট্যাণ্ড রিলিজ করা হয়।

৮ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১০ এপ্রিল তৎকালিন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের নির্দেশে দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হয়। ১২ এপ্রিল অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার দৃষ্টিপাত পত্রিকার সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে গাজীপুর সদরের একটি ব্যাচেলার ছাত্রবাস থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৫ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভৎর্সনা করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত হলেও ওই বেঞ্চ ভেঙে যাওয়ায় প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। নতুন কোন বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন শুনানীর চেষ্টাও করেনি।

(আরকে/এসপি/নভেম্বর ১৬, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test