পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হওয়ায় পাল্টে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র

কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় রাবনাবাদ নদীর তীরে দেশের তৃতীয় ‘পায়রা সমুদ্র বন্দর’ নির্মাণ হওয়ায় পাল্টে গেছে দক্ষিনাঞ্চলের চিত্র। পায়রা বন্দর নির্মানকে ঘিরে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ শুরু হওয়ায় পাল্টে যাচ্ছে উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রা। এ বন্দর কে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এতদাঞ্চলের অবহেলিত মানুষ। এ বছরই নৌ-পথে পণ্য খালাসের মাধ্যমে বন্দরের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও সড়ক পথে কবে পন্য পরিবহণ শুরু হবে তা জানাতে পারছে না  পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।

২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পায়রা বন্দরের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৭ মাস আগে উদ্ধোধন হওয়া এ পায়রা বন্দরে কি কাজ চলছে ও ভবিষতে কি কি কাজ হবে সরেজমিন অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।
সাড়ে ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ে আগামী ১৩ বছরে পূর্নাঙ্গ রুপ পাবে পায়রা সমুদ্র বন্দর। বন্দর নির্মাণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৬ একর জায়গা মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। রাবনাবাদ নদ ঘেষা বন্দরকে ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা করতে প্রায় এক হাজার মিটার নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বন্দরে নির্বিঘ্নে রাতেও কর্মসম্পাদনের জন্য বসানো হয়েছে ৭০টি সৌরবিদ্যুৎ ষ্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়েছে। বসানো হয়েছে সিগন্যাল বাতি। পন্যবাহী জাহাজ ভিড়ানোর জন্য তিনটি পল্টুন বসানোসহ সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পল্টুনে পন্য ওঠা-নামানোর জন্য ভাড়ি দুটি ক্রেন বসানো হয়েছে। বন্দরে ভাড়ি যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য ক্রয় করা হয়েছে দুইটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর। বন্দরের নিরাপত্তার জন্য সেন্ট্রি পোষ্টসহ নিরাপত্তা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্দরকে আধুনিকায়ন করতে কলাপাড়ার ধানখালীতে নির্মাণ হচ্ছে ১৩২০ মেঘাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র।
পায়রা বন্দর সূত্রে জানা যায়, পায়রা বন্দরে নৌ-পথে নিরাপদে জাহাজ চলাচলের জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ২৫ মাইল নৌ-পথ একটি ফেয়ারওয়ে বয়া নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এছাড়া কালিগঞ্জ থেকে বন্দর পর্যন্ত এ্যাপ্রোচ চ্যানেল বয়া নির্মানসহ মধ্য সাগরে জাহাজ নোঙরের জন্য মুরিং বয়া নির্মাণ,জরুরী প্রয়োজনে জাহাজের নাবিকরা যাতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এজন্য ভিএইচএফ যোগাযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি কেন্দ্রীয় স্থাপনা ও লাইট হাউস নির্মান কাজ চলছে।
পায়রা বন্দর এলাকার সীমানা নির্ধারণ ইতিমধ্যে চুড়ান্ত হয়েছে। তবে ‘কর’ অঞ্চল নির্ধারণ হয়নি। এ বছরই বহির্নোঙ্গরের কাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। রাবনাবাদ মোহনা থেকে কাজল, তেতুলিয়া নদী হয়ে কালীগঞ্জ পর্যন্ত সমুদ্রের (নৌ-পথের) গভীরতা যাচাইয়ের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। অধিকাংশ রুটের গভীরতা সাত থেকে ১৫মিটার। তবে শুধুমাত্র চালিতাবুনিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় খনন কাজ করতে হবে। পায়রা বন্দর থেকে কুয়াকাটাগামী মহাসড়কের রজপাড়া পর্যন্ত চার লেনের মূল সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ বছরই মধ্যে এ সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, পায়রা বন্দর এলাকার মালামাল রাখার জন্য গুদাম নির্মাণ, নদীপথে ড্রেজিং, নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি ক্রয়, পাইলট বোট, টাগ বোট এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদির জন্য সাড়ে আট’শ কোটি টাকা চেয়ে উন্নয়ণ প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে।
কলাপাড়ার লালুয়ার চারিপাড়াসহ আশপাশ এলাকার প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চুড়ান্তের পথে। ভবিষ্যতে সাড়ে ৪ হাজার একর জমির ওপর এই পায়রা বন্দরের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ প্রকল্পের জন্য তিনশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। চারিপাড়ায় মূলবন্দরের কাজ শুরু করতে বিদেশী বিশেষজ্ঞ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
পায়রা বন্দর সূত্রে জানা যায়, মাদার ভ্যাসেলকে বহির্নোঙ্গরে রেখে লাইটার জাহাজে এই বন্দর দিয়ে পণ্য ওঠা-নামা করা যাবে। এই বন্দর এলাকা এক্সক্লুসিভ জোনে পরিণত হবে। এছাড়াও নৌবাহিনীকে আধুনিক ও ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে খুব শীঘ্রই সাবমেরিন সংযোজিত হতে যাচ্ছে। দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দরের পাশে স্থাপিত এই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আধুনিক নৌ-ঘাঁটিতে নৌ কমান্ডো, এভিয়েশন, জাহাজ ও সাবমেরিন বার্থিং সুবিধা থাকবে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়,বর্তমানে বন্দরের অভ্যন্তরে বালু ভরাটের কাজ শেষে বিশাল এলাকা জুড়ে ঘাষ লাগানোর কাজ চলছে। তবে বন্দরে প্রবেশের প্রধান সড়কটির বেহাল দশার কারনে দূর্ভোগে পড়েছে এখানে ঘুরতে আসা মানুষ। এ সড়ক উন্নয়ন না হলে সড়কপথে এখান থেকে পণ্য পরিবহন অসম্ভব বলে জানালেন স্থানীয় ব্যবসায়ী চান মিয়া হাওলাদার। তিনি জানান, বন্দর হওয়ায় বিদ্যুত সুবিধাসহ স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক বেড়েছে। এলাকায় বেকারত্ব কমে গেছে।
জানাযায়, পায়রা বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ কার্যক্রমে আর্থিক, কারিগরি এবং জনবল দিয়ে সহায়তা করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এখান থেকে ১১৭ জনের অনুমোদন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন হয়েছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড গঠনের স্বার্থে দুই জন স্থায়ী এবং তিন জন খন্ডকালীন সদস্য এবং ৫ জন কর্মকর্তা এবং ৯ জন কর্মচারি ঢাকা লিয়াজো অফিসে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার লক্ষে ১১ জন রক্ষী এবং ৬ জন আনসার দায়িত্বে রয়েছে এখানে। পায়রা বন্দরের ১৭৮৫ জনের টিওঅ্যান্ডই নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসনে পাঠানো হয়েছে।
আউটার অ্যাংকরেজ থেকে রাবনাবাদ চ্যানেলে প্রবেশের পথে পানির সর্বনিম্ন গভীরতা প্রায় ৫ মিটার। চ্যানেলের ভেতর এই গভীরতা ১৬ থেকে ২১ মিটার। চ্যানেলের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করা হলে জেয়ারের সময় ১৪ মিটার গভীর (চট্টগ্রামে আসে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ২ মিটার) এবং ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজ (চট্টগ্রামে আসে সর্বোচ্চ ১৮৬ মিটার) এখানে আসতে পারবে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ জানান, প্রায় ছয় হাজার একর জায়গার ওপর গড়ে উঠছে সমগ্র পায়রা সমুদ্র বন্দর। বিপুল পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য জায়গা পড়ে আছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। এসব এলাকায় সরকারি এবং বেসরকারি কনটেইনার ডিপো, শিল্প এলাকা, ইপিজেড, আইজেড ইত্যাদি গড়ে তোলা সম্ভব। এ বন্দরকে ঘিরে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বন্দর পূর্নাঙ্গ চালু হলে এখানে সার কারখানা, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙ্গা কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। এছাড়া পটুয়াখালি হয়ে কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত চারলেন বিশিষ্ট সড়ক যোগাযোগ বসানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ফলে পায়রা বন্দরের সাথে সুগম হবে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ। ২০১৮ সালে পদ্মা ব্রিজ নির্মাণ শেষ হলে রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত হবে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সাথে যুক্ত হবে পায়রা বন্দর। পায়রা থেকে বড় নদীতে পড়ার দুটি রুট। একটি পটুয়াখালি হয়ে বরিশাল। অন্যটি ভোলার পশ্চিম থেকে শুরু করে কাজল এবং তেতুলিয়া নদী হয়ে কালিগঞ্জ। আকাশপথে যোগাযোগের জন্যএকটি বিমানবন্দর গড়ে উঠবে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৩ বছরের এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পায়রা বন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠবে শক্তিশালী নানা প্রকার স্থাপনা। ফলে প্রতিহত হবে ঝড়ের আঘাত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহজ হবে এবং উপকূল জুড়ে গড়ে তোলা হবে সবুজ বেষ্টনি এবং ইকো-ট্যুরিজম। পর্যটন উন্নয়নের লক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কমপ্লেক্স,জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপন, পর্যবেক্ষন টাওয়ার, জেটি/ল্যান্ডিংষ্টেশন নির্মাণ, মেরিন ড্রাইভ, ইকোপার্ক, মেরিন পার্ক ও সী-অ্যাকুরিয়াম ও আন্তর্জাতিক মানের ষ্টেডিয়াম নির্মাণ করা হবে।
স্থানীয় সাংবাদিক এসএম মোশারফ হোসেন মিন্টু বলেন, পায়রা বন্দর নির্মাণ হওয়ায় এলাকার জমির দাম কয়েক গুন বেড়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিনিয়োগকারীরা জমি ক্রয় করার জন্য এখানে আসছে। তবে টিয়াখালী ইউনিয়নে জমি ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা।
পায়রা বন্দর সংলগ্ন টিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সুজন মোল্লা জানান, গত ১৭ মাসে টিয়াখালী ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ করেছে। প্রতিদিনই বন্দরে বিভিন্ন কাজে স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে। এ কারনে এলাকায় বেকারত্ব কমে গেছে। পায়রা বন্দর দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতশত মানুষ আসছে। এ কারনে বন্দরের আশেপাশে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাছাড়া চার লেন রাস্তা নির্মাণ শুরু হলে কলাপাড়া ছাড়াও বাহির থেকেও শ্রমিক আনতে হবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মাহাবুবুর রহমান তালুকদার বিভিন্ন সভায় বলেন, পায়রা বন্দর চালু হলে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক জোন হবে কলাপাড়া। আগে কলাপাড়ার বেকার মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমবিক্রি করতে গেলেও এ বন্দর চালুহলে ঢাকার মানুষ এখানে আসবে কাজের সন্ধানে। এটা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি অংশ।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড মেম্বার (হারবার ও মেরিন) ক্যাপ্টেন সাইদুর রহমান জানান, এ বছরই বন্দর থেকে পন্য খালাসের চিন্তা রয়েছে। এজন্য রাস্তা নির্মাণ জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে আগামী এক বছরের মধ্যে চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে বলে জানান। আর ইতিমধ্যে বন্দরের নিরাপত্তা ভবন নির্মাণ শেষ হয়েছে। সীমানা নির্ধারণ চুড়ান্ত হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বর্তমান নৌ-পথ উন্নয়নের কাজ চলছে।

(এমআর/পিবি/মে ২৭,২০১৫)