E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ছন্দে ছন্দে শিক্ষার আলো

২০১৫ সেপ্টেম্বর ০৯ ১৩:১৭:২৫
ছন্দে ছন্দে শিক্ষার আলো

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি: মঙ্গলবার দুপুর তিনটা। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে চারিদিকে সুনশান নিরবতা। স্কুল-কলেজ ছুটি হয়েছে অনেক আগে। হঠাৎ চোখে পড়ল গ্রামের সবুজ মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন গৃহবধু।

তাদের হাতে বই,খাতা। কেউ কেউ মুখে অ আ ক খ কেউবা ১ ২ ৩ পড়ছে। কারো মুখে শিশুদের ছড়া। শিশুদের এ পাঠ তারা হাসি মুখে বলে যাচ্ছে কিন্তু তাদের নেই কোন জড়তা। বরং অজানাকে জানার আগ্রহে তারা সবাই উৎফুল্ল।

মাত্র ছয় মাস আগেও কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামের এই গৃহবধুরা ছিলো নিরক্ষর। রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কথা হয় এতোদিন শিক্ষার অন্ধকারে থাকা কল্পনা রানী, শিপ্রা, পারুল মিত্র, শেফালী, সুমি বেগমমের সাথে। সেখানেই জানা যায় এই গৃহবধুদের সাক্ষরজ্ঞান অর্জনের গল্প।

“সাক্ষর মা”। নিরক্ষর মায়েদের সাক্ষরজ্ঞান করে তোলার একটি স্কুল। কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ও সমুদ্র ঘেষা ধুলাসার ইউনিয়নের ১২টি স্কুলে পড়ে মাত্র ছয় মাসে ২৬৪ জন নিরক্ষর মা এখন বই পড়তে পারছে। লিখতে পারছে নাম ঠিকানা। সন্তানদের লেখাপড়ায়ও সহায়তা করতে পারছে। অথচ এরা শৈশবে কেউ স্কুলের বারান্দায়ও যেতে পারেনি আর্থিক দৈন্যতা, পারিবারিক অসহযোগীতা ও কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করার কারণে।

দুই সন্তানের জননী কল্পনা রানী (৪০)। তার ছেলে দোলন হাওলাদার পটুয়াখালী পলিটেকনিক্যাল কলেজে এইচএসসি ও মেয়ে শান্তা খেপুপাড়া মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অস্টম শ্রেণিতে পড়ছে। ছেলে-মেয়েদের বাসার শিক্ষায় এতোদিন কোন সহযোগীতা করতে পারেননি। নিজে সাক্ষর জানত না তাই ভোটার আইডি কার্ডে দিতে হয়েছে আঙ্গুলের ছাপ। ব্যাংক হিসাব করতে সাক্ষর জানতে হবে তাই করতে পারেননি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট। এখন কল্পনা রানী লিখতে ও পড়তে পারে। নবীপুর “সাক্ষর মা” স্কুলে লেখাপড়ায় ব্যস্ত তার মতো আরও ২৩ জন। যারা সবাই এখন লিখতে ও পড়তে পারে।

কল্পনা রানী বলেন, 'মাইয়া দেইখ্যা আমাগো সময় মাইয়াগো স্কুলে পাডায় নায়। ঘরে রান্না-বান্না শেখাইছে। ঘরের কাজ করাইছে। কিন্তু আমার ভাই ইসকুলে গ্যাছে। যহন একটু বড় হই বিয়া দিয়া দেয়। হেইয়ার লাইগ্যা মোগো আর বই পড়া হয় নায়। কিন্তু এ্যাহন বুঝি আমাগো ল্যাহাপড়া না করাইয়া বাবা-মায় কি ভুল করছে।'

তিনি বলেন, 'নিজে ল্যাহাপড়া না জানায় মাইয়া পোলাগো ছোডকালে পড়াইতে পাড়ি নাই। মাষ্টার রাইখ্যা পড়াইতে হইছে। এই স্কুলে আইয়া এ্যাহন মুই বই পড়তে পারি। ল্যাকতে পারি।'

শেফালী রানী (৫০) বলেন, ‘ছোটবেলায় পড়াল্যাহা করতে পারি নাই। এহন বুঝতে পারছি, লেখাপাড়া না জানলে কি সমস্যা হয়। হক্কল ইউনিয়ন পরিষদ, অফিস-আদালতে কাজে গেলেই স্বাক্ষর দিতে অয়। আমরা দিতে পারতাম না। স্বাক্ষর দিতে না পারলে যারা স্বাক্ষর জানে হেরা আমাগো দেইখ্যা হাসতো। হেইয়ার লাইগ্যা এই ইসকুলে নামদস্তগত শেখতে আইছি। এ্যাহন মুই সব পাড়ি।

পুতুল রানী বলেন, 'মাইয়াডা ইসকুলে ফাইবে পড়ে। এ্যাতোদিন ইসকুলে কত মিটিংয়ে আমারে যাইতে কইছে। সরমে যাই নাই। এ্যাহন মা সভা হইলেই যাই। কারন মুই এ্যাহন ল্যাকতে পারি।'

নবীপুর গ্রামের “সাক্ষর মা” স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে , বাড়ির উঠোনে ছালা বিছিয়ে দুপুরের পর থেকে চার/পাঁচজন দলবেঁধে গল্প করছে। তবে তাদের এই গল্প পারিবারিক না, শিক্ষার। কে কি শিখছে, কে কি লিখতে পারছে তা একে অন্যকে দেখানোর ও জানানোর। এভাবেই তারা শিখে ফেলেছে বর্নমালা।

এই স্কুলের শিক্ষিকা তমা রানী বলেন, 'মায়েদের পড়ানো, লেখানো এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। তারা অল্প সময়েই শিখে ফেলছে। তাছাড়া সংসারের কাজ শেষ করে তারা সময়মতো প্রতিদিন স্কুলে আসে।'

মায়েদের পাঠ্য বইতেও রয়েছে ভিন্নতা। গত মার্চ মাসে শুরু হওয়া এই শিক্ষা কার্যক্রমে প্রথম তিন মাসে বর্ণমালা শিখাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘শিকড়’ নামের একটি বই। এই বইতে বর্ণমালা, চিহ্ন ও সংখ্যা চেনার উপায় রয়েছে। দ্বিতীয় তিন মাসে ‘সংযোগ’ নামের বই পড়ানো হয়। এই বইতে ছবি দেখে জানা-শেখা এবং গল্পের বই পড়া, বিনোদন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য তথ্য এবং নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করা হয়। তৃতীয় তিন মাসে ‘প্রয়োগ’ বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষনীয় জ্ঞানের আলোকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগের জন্য আবেদন পত্র লেখা, নাম-ঠিকানা লেখা, নিজের পছন্দ মতো লিখতে সহায়তা করা হয়।

স্টুওয়ার্ড শিপ ফাউন্ডেশন ইউকে’র অর্থায়ানে এফএইচ এ্যাসোসিয়েশন সংস্থা (বয়ষ্ক স্বাক্ষরতা কার্যক্রম) কলাপাড়ায় “সাক্ষর মা’ স্কুল পরিচালনা করছে। উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ছয়টি স্কুলে ১৩০ জন ও ধুলাসার ইউনিয়নে ছয়টি স্কুলে ১৩৪ জন নিরক্ষর মা এই প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার আলোতে এসেছে।

মা সাক্ষরজ্ঞান লিটারেসী অর্গানাইজার মো. মিন্টু আহম্মেদ জানান, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নিরক্ষর মায়েদের শিক্ষার আলোতে আনাই তাদের লক্ষ।

এফএইচ’র আঞ্চলিক প্রকল্প সমন্বয়কারী গৌতম দাস বলেন, কলাপাড়ায় ‘কমপ্রেহেনসিভ ফেমিলি এন্ড কমিউনিটি ট্রান্সফরমেশন’ প্রকল্পের আওতায় ‘স্বাক্ষর মা’ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পরিবার, সমাজ এবং দেশের উন্নয়নে নারীরা যাতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে এই জন্য তারা “সাক্ষর মা” স্কুলের মাধ্যমে কাজ করছেন। আগামী নভেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে এই কার্যক্রম।

কলাপাড়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, শিশুদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে মায়েদের সচেতন হতে হবে। সাক্ষর মা স্কুলের মাধ্যমে ২৬৪ মা এখন শিক্ষার আলোতে এসেছে এটা সমাজের জন্য শিক্ষনীয়। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে দেশে ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও কমে যাবে।

(এমকেআর/এলপিবি/সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test