E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কলাপাড়ার 'মুক্তা' এখন মুক্তির দূত

২০১৫ সেপ্টেম্বর ২৮ ১৩:৩৫:৪৩
কলাপাড়ার 'মুক্তা' এখন মুক্তির দূত

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি: টানা তিন মাস শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করেও বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে মিতু আক্তার মুক্তা (১৪)।

উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নপূরন করতে পরিবারের উল্টো স্রোতে থেকেও নিজেকে রক্ষা করেছেন। বিয়ে পাগল বাচ্চু খাঁকে ধরিয়ে দিয়েছে প্রশাসনের হাতে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার চম্পাপুর ইউনিয়নের পাটুয়া গ্রামের মুক্তা এখন উপকূলীয় স্কুল পড়ুয়া কিশোরীদের কাছে “মুক্তির দূত” হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

উত্তর পূর্ব পাটুয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মুক্তা। শ্রমজীবি মহিউদ্দিন প্যাদার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবার ছোট। ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গ্রামের অবহেলিত নারীদের জন্য কাজ করা। টিভিতে বাল্যবিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখে এলাকায় কিশোরীদের রক্ষার জন্য পন করেছিলেন। কিন্তু মুক্তা কখনও ভাবেনি, সে যখন এই স্বপ্ন দেখছে তার আগেই তাকেও বাল্যবিয়ের কবলে পড়তে হয়েছে।

মুক্তা জানায়,“আমি যহন সিক্সে পড়ি তহনই নাকি বাচ্চু খাঁ’র লগে আমার বিয়া হইছে। তিন মাস আগে আমি জানতে পারি এই বিয়ের কথা। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার সুযোগ নিয়ে কিছু জমি লিখে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তার অজান্তেই পরিবারের লোকজন তাকে বিয়ে দিয়ে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে বসে কথা হয় মুক্তার সাথে। ফুটফুটে ছোট্ট কিশোরীর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। ঘুষির আঘাতে বাম চোখে এখন অস্পষ্ট দেখছে সে। দুই গালে এলোমেলো বড় বড় আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট। পা ও দুই হাতেও লাঠির আঘাতের চিহ্ন। একই অবস্থা সমস্ত শরীরে। গত তিন মাসের লোমহর্ষক নির্যাতনের যখন বর্ননা দিচ্ছিল মুক্তা, তখন তার দুই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।

মুক্তা জানায়, তিন মাস আগে এক দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে নিজ রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ এক ব্যাডারে (তখন বাচ্চু খাঁ’র নাম জানত না) রুমে নিয়ে আসে তার মা লুৎফা বেগম। জানায় এই তোর জামাই। দুই বছর আগে তোরে বিয়া দিছি বাচ্চুর সাথে। এ্যাহন থেকে জামাই তোর রুমেই থাকবে। মায়ের কথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তাৎক্ষণিক রুম থেকে বের হয়ে আশ্রয় নেয় ভাবি সেলিনা বেগমের রুমে। প্রথম দিনে স্বামীর কাছ থেকে পালাতে পারলেও এরপর আর পারেনি। প্রতিদিনই বাচ্চু খাঁ মুক্তাদের বাসায় আসতো। মুক্তার রুমে গিয়ে স্বামীর অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতো। কিন্তু মুক্তা এ বিয়ে মেনে না নেয়ায় তার উপর শুরু হয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একাধিক বিয়ে করা বাচ্চুকে মুক্তা মেনে না নেয়ায় মা, দুই ভাই মহসীন, মশিউর তাকে প্রায় প্রতিদিনই মারধর করতো। এ নির্যাতন চলে গত তিন মাস পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় মুক্তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় মা, ভাই ও বাচ্চু। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছা মুক্তার। তাই পালিয়ে প্রতিবেশী অন্য সহপাঠীদের কাছে পাঠ্যবই দিয়ে গোপনে স্কুলে যেতো। স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে তাকে এই বাল্য বিয়ের কবল থেকে রক্ষার জন্য সকলের কাছে সহযোগীতা চাইতো। এ খবর পরিবারের লোকজন জেনে ফেলায় তার স্কুলে যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা দেয়ার পর আর স্কুলে যেতে পারেনি।

মুক্তা জানায়, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়ায় বাধ্য হয়ে মুক্তা পালিয়ে ঢাকা চলে যায় তার খালার বাসায়। কিন্তু সেখানে একদিন থাকার পর আবার তার ভাই তাকে নিয়ে আসে। গত মঙ্গলবার রাতে মুক্তার উপর আবার নির্যাতন চালায় স্বামী বাচ্চু। কোন উপায় না পেয়ে স্কুলের এক শিক্ষকের সহায়তায় কলাপাড়া থানা পুলিশের সহায়তা চায় মুক্তা। পুলিশ ওই রাতেই মুক্তাকে উদ্ধার করে এবং গ্রেফতার করে নির্যাতনকারী বাচ্চুকে।

পুলিশ আসার খবর পেয়ে পালিয়ে যায় মুক্তার পরিবারের লোকজন। মুক্তার সহপাঠীরা জানায়, মুক্তা লেখাপড়া শিখে এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলো। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে ছিল সচেতন। কিন্তু তাকেই বসতে হয়েছে বাল্যবিয়েতে। তিন মাস নির্যাতন সহ্য করে এই বাল্যবিয়ের শিকল থেকে মুক্ত হয়ে মুক্তা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এই এলাকায় যাতে আর কোন কিশোরীর বাল্যবিয়ে না হয়ে তারা এখন বিষয়টি দেখবেন।

অভিযুক্ত বাচ্চু খাঁ বলেন, তিনি মুক্তা কে বিয়ে করেছেন তার পরিবারের ইচ্ছায়। কিন্তু এভাবে কেন নির্যাতন করেছেন জানতে চাইলে বলেন আর মারবেন না।

কলাপাড়া থানার ওসি(তদন্ত) মো. মনিরুজ্জামান জানান, জোড় করে মুক্তাকে বাল্যবিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারনে বাচ্চুকে গ্রেফতার করে বুধবার রাতে ভ্রাম্যমান আদালতে হাজির করা হয়েছে।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের চার ধারা মোতাবেক বাচ্চু খাঁকে এক মাসের কারাদন্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং কিশোরী মুক্তাকে কলাপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার বদিউর রহমান বন্টিনের হেফাজতে দেয়া হয়েছে।

(এমকেআর/এলপিবি/সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test