E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাগেরহাটে নির্মাণের পরেই অকেজো ‘পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট’ 

২০২১ মার্চ ৩০ ১৬:৪২:৩২
বাগেরহাটে নির্মাণের পরেই অকেজো ‘পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট’ 

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : বাগেরহাটের উপকূলীয় দু‘টি উপজেলা  রামপাল ও মোংলায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে নির্মিত ‘সয়ংক্রিয় সৌরচালিত পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট’ এখন স্থানীয় জনগনের চোখের কাটায় পরিনত হয়েছে। লবনাক্ত এই অঞ্চলের দুঃস্থ ও হতদরিদ্র মানুষের সুপেয় পানি পাওয়ার আশার ‘গুড়ে বালি’ পড়েছে। নির্মানের পরেই অকেজো হয়ে পড়েছে অধিকাংশ পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট। এতে স্থানীয়দের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আর জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের ৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি স্থানীয়দের সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।  তবে অজ্ঞাত কারনে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এবিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। 

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে “ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলার জন্য বাগেরহাট জেলার দুঃস্থ ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ” প্রকল্পের আওতায় ৮ কোটি টাকা ব্যায়ে ২০২টি ‘সয়ংক্রিয় সৌরচালিত পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট’ নির্মানের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে।

বিগত ২০২০ সালের জুলাই মাসের দিকে মোংলা উপজেলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নে প্রথম এই পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিটের নির্মান কাজ শুরু হয়। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের না জানিয়েই ১৫টি ইউনিট নির্মান করা হয়। উপকারভোগীদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়া এবং নিম্নমান সামগ্রী দিয়ে দায়সারা ভাবে প্রকল্পের কাজ শুরু করার অভিযোগ উঠলে এই আসনের সংসদ সদস্য ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রি হাবিবুন নাহারকে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন। এরপর সেই ১৫টি ইউনিট ভেঙ্গে আবার নির্মান করা হয়।

পরবর্তিতে প্রকল্প মেয়াদ (২০২০ সালের ডিসেম্বর) পর্যন্ত মোংলায় ১৩৫টির মধ্যে ৪৪টি এবং রামপালে ৬৭টির মধ্যে ২৬টি ইউনিট নির্মান করা হয়েছে। কিন্ত নির্মানের পর পরই এর বেশির ভাগ ইউনিট ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন-২ শাখার পত্রে প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন এলাকায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে অনুমোদিত প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট তথ্য সম্বলিত দৃশ্যমান সাইনবোর্ড স্থাপন করার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যায়নি। প্রকল্পের নির্মান কাজ দেখভালের দয়িত্বে এলাকায় তেমন কাউকে দেখা মেলেনি বলে স্থানীয়রা জানান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় পুকুর দিয়ে পনি এনে বড় পানির ট্যাকিংতে রাখতে হবে। সোলারে প্লেটে বিদ্যুৎ তৈরি হয়ে তা দিয়ে পানি উঠে প্যানেলে যাবে। সুর্যের আলোতে বাষ্প হয়ে সেই পানি ৫টি প্যানেল ঘুরে আবার ছোট পানির ট্যাকিংতে এসে জমা হবে। সেখান থেকে জনসাধারন সুপেয় পানি নিবে। প্রতিটা ইউনিটের ব্যয় ধরা হয়েছে, ৩ লাখ ৯২ হাজার ২শ টাকা।

কিন্তু এই বড় পানির ট্যাকিংতে পানি তোলার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আর বেশির ভাগ ইউনিটে পানি দেয়া থাকলেও সুপেয় পানি উৎপাদন হচ্ছে না।

মোংলা উপজেলার মাকড়ডন গ্রামের ফজলুর রহমান বলেন, পানির প্লান্ট নির্মান করতে দেখে মনে করেছিলাম আমাদের পানির কস্ট বুঝি কিছুটা কমবে। কিন্তু নির্মানের ১০দিন পর থেকে এই প্লান্ট থেকে কেউ একফোঁটা পানিও নিতে পারছে না। কোথায় কি সমস্যা হয়েছে তা দেখারও কেউ নেই।

একই এলাকার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। পানির প্লান্ট তৈরি করার পরপরেই নষ্ট হয়ে গেছে। কোন ভাবে রেখেই সবাই কেটে পড়েছে। তাছাড়া আমরা ঝড়-বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ। কোন রকমে দায়সারা ভাবে যে পানির প্লান্ট নির্মান করা হয়েছে তা সামান্ন ঝড় এলেই আকাশে উড়বে।এটা সরকারী অর্থ লুটপাট ছাড়া আর কিছু না!

নারকেলতলা আবাসন এলাকার ফজিলা বেগম বলেন, এখানে দুটি প্লান্ট তৈরি করা হয়েছে, যার একটাতে জীবনে একফোঁটা পানিও তৈরি হয়নি। আর একটায় সারাদিন বসে এক লিটার পানি তৈরি হয়। এটা দিয়ে কি হবে?
আমরা জানতে চেয়েছিলাম পানি কম আসছে কেন? তারা বলেছিল, এখন শীতকাল। গরম কাল আসলে বেশি পানি পাবেন। এখনতো পচন্ড গরম। তাহলে আর কত গরম আসলে পানি পাবো?

একই এলাকার আব্দুল খালেক বলেন, এই আশ্রয়ন প্রকল্পে এতো লোকের জন্য মাত্র দুটি প্লান্ট। আর সেই দুটোর দুটিই নস্ট।

মিঠাখালী ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামের কুবের বৈরাগী জানান, আমার এখানে খাবার পানির ফিল্টার বসানেরা কথা বলেছিল। এখন তাদের আর কোন খোঁজ খবর নেই।

এই বিষয়ে মোংলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যন পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট নির্মানে অনিয়ম ও নির্মিত ইউনিটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ার কথা স্বীকার করলেও অজ্ঞাত তারা কারনে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলার জন্য বাগেরহাট জেলার দুঃস্থ ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ” প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের সচিব ( উপ-সচিব) শুভাশীষ সাহা জানান, করোনার কারনে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়েছে। তিনি দুইবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পদাধিকার বলে প্রকল্প পরিচালক হয়েছেন দাবী করে তিনি বলেন, মুলতঃ উপ-প্রকল্প পরিচলকই সবকিছু ভাল জানেন।

এই প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক (অভিযোজন) মো. ইসকান্দার হোসেন বলেন, কিছু কিছু অভিযোগ আমরা পেয়েছি। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়ার পর সমাধান করা হবে।

এ বিষয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাসুদ আহম্মদ বলেন, আমাদের আট শতাধিক প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রতিটা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বিষয়টি দেখে থাকেন।

সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মান সম্মত নির্মান সামগ্রী দিয়ে জনসাধারনের ব্যবহার উপযোগী করে প্রতিটা ইউনিট তৈরি করার দাবী স্থানীয়দের।

(এসএকে/এসপি/মার্চ ৩০, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test