E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আসল কাজী জেলে কিন্তু বিয়ে পড়াচ্ছেন কে?

২০২১ মে ২৭ ১৩:৩৭:২২
আসল কাজী জেলে কিন্তু বিয়ে পড়াচ্ছেন কে?

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও সরকারি কাজে বাধাদানের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ ১ মাস যাবত জেলে রয়েছেন চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা কাজী শরফুদ্দিন মোহাম্মদ সেলিম (৫১)। কিন্তু কাজী জেলে থাকলেও কাজীর অবর্তমানে চরপাথরঘাটা কাজী অফিসে কামরুল ইসলাম (৩৫) নামে জনৈক ব্যক্তি নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার কার্যক্রম চালিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত মার্চ মাসে হাটহাজারীতে আলোচিত হেফাজতে ইসলামের তান্ডবের প্রতিক্রিয়ায় পটিয়ায় সংঘটিত ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পটিয়া থানা মামলা নং- ৫০/১১৭) গ্রেপ্তার হন পটিয়া উপজেলাধীন ৫নং হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার কাজী শরফুদ্দিন মোহাম্মদ সেলিম। একই ব্যক্তি আবার ওই উপজেলা থেকে প্রায় ৩৫ কিঃমিঃ দূরে কর্ণফুলী উপজেলার ১ নং (খ) চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা কাজী দাবিদার।

এদিকে, কাজী গ্রেপ্তার হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) মিনহাজ মাহমুদ ভূইয়া জানান, গত ২৬ এপ্রিল কাজী শরফুদ্দিন মোহাম্মদ সেলিম ও আলী আজগর নামে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে কাজী শরফুদ্দিন মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে পটিয়া থানায় আরো দুটি মামলার খোঁজ পাওয়া যায় বলে তিনি জানান।

কিন্তু আসল কাজী সরকারি কাজে বাধাদানের মামলায় জেলহাজতে বসবাস করলেও চরপাথরঘাটায় কামরুল ইসলাম নামে জনৈক ব্যক্তি নিজেকে কাজী পরিচয় দিয়ে সহজ সরল মানুষের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। এমনকি সাইনবোর্ডে কাজী পরিচয়ে সাটানো হয়েছে নিজের মোবাইল নম্বরও। চরপাথরঘাটাবাসী অভিযোগ তুলেছেন, সরকারি ভলিয়মে বিয়ের নিবন্ধন ও রেজিস্ট্রার হচ্ছে না কিনা তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

এমনকি এখনো স্পষ্ট নয়, অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে কে বৈধ আর কে অবৈধ কাজী। বিষয়টি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে জেলা রেজিস্ট্রারের সুনজর প্রত্যাশা করেছেন। সাধারণ মানুষ চান বৈধ কাজীর অফিস বলবৎ থাকুক। আর যাকে সরকার দায়িত্ব দিয়েছেন সে নিজে অফিসে এসে দায়িত্ব পালন করুক। সাধারণ মানুষ দাবি জানান, কাজীর নাম দিয়ে অন্যকেহ যেনো প্রতারণা না করুক। কেনোনা অতিরিক্ত কাজী দাবিদার শরফুদ্দিন মোহাম্মদ সেলিমের পক্ষে যুবক কামরুল ইসলাম নামক জনৈক ব্যক্তি নিজেকে কাজী পরিচয় দিচ্ছেন। নকল জন্মসনদ ও ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন করে আসছেন। এমনকি নাবালিকা মেয়েদের সাবালক বানিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

সাধারণ মানুষ এই প্রতারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেছে, কিসের উপর ভিত্তিতে তিনি চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে কাজীরা দায়িত্ব পালন করছেন। সরকার যদি শরফুদ্দিন মোহাম্মদ সেলিম কে চরপাথরঘাটার অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। তবে তিনি স্বশরীরে এসে অফিস করলে কোন বাধা নেই বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

কোন ধরনের নিয়ম নীতি তোয়াক্কা না করে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গাফিলতি ও অবহেলার সুযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তিনি হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ যেন দেখার কেউ নেই। কেননা বিবাহ নিবন্ধনের কোন আইনকেই মানছেন না। নেই কোন কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার একসেস। ভুয়া জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয় যাচাই বাচাই ব্যতীত দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনকে বিবাহ পড়িয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো অহরহ অভিযোগ আসছে।

এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের বরাদ্দকৃত ভলিয়ম ও সিল ব্যবহার করার। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জনৈক কামরুল ইসলাম ইসলামের নম্বরে রিং করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাবার পর কথা বলতে রাজী হননি। পরে পূনরায় অন্য নাম্বার থেকে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘কাজী শরফুদ্দিন মোহাম্মদ সেলিম কোন মামলায় জেলে গেছে তা আমি জানি না। আমি কোন কথা বলতে পারব না বলে ফোন লাইন কেটে দেন।’

এদিকে, অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া যায়-২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১নং (খ) চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের তৎকালিন কাজী মৌলানা নুরুল হুদা অবসরে যান। অবসর গ্রহণের কিছুদিন পরে মারা যান তিনি। একই বছরের ১৪ মার্চ জেলা রেজিস্ট্রার পটিয়া উপজেলার ৫নং হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের শরফুদ্দীন মোঃ সেলিমকে চরপাথরঘাটা শুন্য পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন। ২০১০ সালের ২৬ মে উক্ত কাজীর অতিরিক্ত দায়িত্ব শেষ হয়।

পরবর্তীতে প্রয়াত সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সুপারিশে ২০১১ সালের ২১শে আগষ্ট ১নং চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিস্ট্রার সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলামকে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার এক মাস যেতে না যেতেই পুর্বে অবসর প্রাপ্ত কাজী মৌঃ নুরুল হুদার পুত্র আবদুল্লাহ আল মামুনের করা রীটে (৭৯৮৫/০৯) সে দায়িত্ব স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে কাজী সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলামের দায়ের করা রীটে (৫২৯১/১০) হাইকোর্ট ও সাব রেজিস্ট্রার ওই আদেশ স্থগিতাদেশ খারিজ করে দেন। এমনকি পুনরায় ২০১১ সালের ২১ আগষ্ট অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে জেলা রেজিস্ট্রার হতে নির্দেশনা পান।

কিন্তু এরইমধ্যে পোষ্য কৌটায় অবসর প্রাপ্ত কাজীর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন রীট করে এই শুন্য পদে নিয়োগ পেতে চেষ্টা করেন। আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাউকে স্থায়ী নিয়োগ না দিতে নির্দেশনাও দেন। অন্যদিকে কাজী শরফুদ্দীন মোহাম্মদ সেলিম দাবি করছে, সে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও ১৯৭৫ সালের বিধি ২ ধারা মতে মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রীকরণ আইনের রয়েছে, কারো অতিরিক্ত দায়িত্বকাল ৬০ দিনের জন্য বরাদ্দ থাকিবে, ৬১তম দিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা শুন্য হয়ে যায়। জনমনে প্রশ্ন উঠে, তাহলে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ কিংবা মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রীকরণ আইনের কোনটাই কি মানা হচ্ছে না কাজীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে?

জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে তথ্য পাওয়া যায়, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রার পদ শুন্য। এমনকি মহামান্য হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং ৭৯৮৫/০৯ইং ও কনটেম্পট পিটিশন ২৫১/১১ইং বিচারাধীন থাকায় অদ্যবধি নিয়োগ কিংবা অতিরিক্ত দায়িত্বের কোন আদেশ বর্ধিত করা সংক্রান্ত কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে অতিরিক্ত দায়িত্বের নামে এরা কারা? যারা নিজেকে কাজী দাবি করে কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রিকরণ ২০০৭ সালের আইনের (১) ধারামতে জানা যায়, মৃত্যু, অবসর, ইস্তেফাজনিত বা অন্য কোন কারণে পদ শুন্য হলে পুরণ সংক্রান্ত আইনে বলা আছে, পার্শ্ববর্তী এলাকার নিকাহ্ রেজিস্ট্রারকে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের। কিন্তু চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের পার্শ্ববতী ইউপি চরলক্ষ্যা হলেও কর্ণফুলীর উপজেলার সম্পুর্ণ বাহিরে ভিন্ন একটি উপজেলা পটিয়ার কাজীকে দায়িত্ব দেয়া কতটা যুক্তিসংগত ও আইন পরিপন্থী?

জানা যায়, ২০০৭ সাল হতে শরফুদ্দীন মোঃ সেলিম নিকাহ্ রেজিস্ট্রির দায়িত্ব নিলেও কখনো নিয়মিত অফিসে আসেননি। গ্রামের অনেকে তাকে দেখেননি ও চিনেনও না। জুলধা ইউনিয়নের জনৈক কামরুল ইসলাম যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করে বলে জানা যায়। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, তিনি বিভিন্ন ভাবে সাধারণ মানুষকে আর্থিকভাবে হয়রানি করছেন। এমন অভিযোগে, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাজী ছাবের আহমেদ এক সময় কাজী অফিসে তালা লাগিয়ে দেন। প্রায় দু’মাস অফিস বন্ধ থাকে।

সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের নিকাহ এ তালাক রেজিস্ট্রার পদ শূণ্য থাকায় চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের কাজী সৈয়দ মোঃ নজরুল ইসলামের হাইকোর্ট রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে চরপাথরঘাটায় কাজী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে জনস্বার্থে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব দিয়ে আদেশ প্রদান করেন চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার তাপস কুমার রায়। কিন্তু এর ৫ দিন পর মহামান্য হাইকোর্টের রীটে (পিটিশন নং-৭৯৮৫/২০০৯ ও কনটেম্প পিটিশন নং-২৫১/২০১১) এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আদেশে পূর্বের আদেশ প্রত্যাহার করেন জেলা রেজিস্ট্রার।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুকান্ত সাহা জানান, ‘কাজী তো একজন। কাজীর অবর্তমানে অন্য কেউ কাজীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। আবার অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে যেই আসুক না কেন। কাজী ছাড়া যেন কোন মুহুরী/সহকারি বিয়ে না পড়ান। যদি কেউ পড়ান তাঁকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’

চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার তাপস কুমার রায় জানান,‘চরপাথরঘাটার কাজী নিয়ে নানা অভিযোগ আসছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে পটিয়া সাব রেজিস্ট্রার অফিস এখনো কোন চিঠি পাঠায়নি। যদি পাঠান অবশ্যই এ্যাকশনে যাব। অন্যদিকে কাজী ছাড়া অন্য কেউ নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রারের কাজ সম্পাদন করতে পারেন না। কারণ সরকার কোন মুহুর কে দায়িত্ব দেন নাই।’

(জেজে/এসপি/মে ২৭, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test