E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টাঙ্গাইলের কৃষ্ণা সারা দেশের গর্ব

২০২২ সেপ্টেম্বর ২২ ১৯:১৪:৪৪
টাঙ্গাইলের কৃষ্ণা সারা দেশের গর্ব

মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জোড়া গোল করে বাংলাদেশকে জয়ী করে আলোচনায় আসা কৃষ্ণা রাণী সরকারের গ্রাম টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া এলাকার মানুষ বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতেছেন। সোমবার স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ হারিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ জিরোপা জেতার পর কৃষ্ণার বাড়িতে দলে দলে মানুষ ভিড় করছেন। তার কৃতিত্বের সব পুরস্কার ও সার্টিফিকেট, ট্রফি ও খেলার ছবি ঘরের বারান্দায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কৃষ্ণা ওই গ্রামের নমিতা রানী ও বাসুদেব চন্দ্র সরকারের মেয়ে।

কৃষ্ণা রাণী সরকারের বাড়িতে আসা স্থানীয় মো. মুন্না বলেন, ‘কৃষ্ণা রাণী সরকারের গোলের কারণেই বাংলাদেশ জিতেছে। এজন্য তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। সে আমাদের এলাকার গর্ব। এলাকার মানুষ হিসেবে তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। কৃষ্ণা আরও বড় হোক।’

মিরাজুল নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘আমি পুরো খেলাটিই দেখেছি। তার এমন জোড়া গোলে বাংলাদেশ জিতেছে। আমরা অনেক খুশি!’

জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই কৃষ্ণা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। তার খেলাধুলার হাতেখড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। বাবার পরেই ফুটবলার হওয়ার পেছনে তার কাকার অবদান। সকালে কৃষ্ণা ঘুম থেকে তুলে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন কাকা নিতাই চন্দ্র সরকার। আসা-যাওয়ার ভাড়াটাও কাকাই দিতেন। এরপর উপজেলা পরিষদ থেকে সাইকেল দেওয়ার পর অনুশীলনে যেতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি। এক সময় দর্জির দোকান ছিল কৃষ্ণার বাবা বাসুদেব সরকারের। টাকার অভাবে অনেক আগেই দোকানটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। বর্তমানে কৃষিকাজ করে সংসার চালান তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি উপজেলার সুতি ভিএম পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের হয়ে ক্রীড়াঙ্গনে অংশ নেন কৃষ্ণা। তার নেতৃত্বেই এই বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবলে ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে পরপর তিনবার জাতীয় আন্তস্কুল চ্যাম্পিয়ন হন তারা। এভাবেই কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরও দুই কিশোরী ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দলে জায়গা করে নেন। কৃষ্ণা রানী সরকার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ মহিলা জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক।

কৃষ্ণা রাণী সরকারের বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার বলেন, ‘খেলার সময় বিদ্যুৎ না থাকায় পাশের এলাকায় গিয়ে খেলাটি দেখেছি। প্রথম গোলটি করেছে শামসুন্নাহার জুনিয়র। এর পরপর দুটি গোল করেছে আমার মেয়ে কৃষ্ণা রাণী সরকার। আমি তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। সেখানকার লোকজন তখন “কৃষ্ণা রাণী,” “কৃষ্ণা রাণী” বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন। সে সময় আমি আরও বেশি আনন্দিত হচ্ছিলাম! এই লড়াইটি ছিল পুরো বাংলাদেশের। আমার মেয়ে কৃষ্ণা রাণী সেই লড়াইয়ে জিতেছে। এই জয় বাংলাদেশকে আরও অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষ্ণা ছোটবেলা থেকেই অনেক সাহসী ছিল। সব সময় ফুটবল নিয়ে খেলা করতো। তার কাকা ছোটবেলায় তাকে একটি বল কিনে দেয়। পরে তারা দুই ভাইবোন বল নিয়ে ঝগড়া করায় তার মা সেটি কেটে ফেলে। কৃষ্ণার কান্নাকাটির পর আমি আবার তাকে একটি বল কিনে দিই। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল পর্যায়ে কৃষ্ণা অনেক ভালো খেলেছে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফুটবলেও ভালো খেলেছে। সুতি ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন জাতীয় আন্তস্কুল টুর্নামেন্টের খেলায় নেতৃত্ব দিয়েছে। এখন আমার মেয়ে অনেক বড় খেলোয়ার হয়েছে, এটা আমার গর্ব!’

কৃষ্ণার মা নমিতা রাণী বলেন, ‘খেলার সময় বিদ্যুৎ ছিল না। এজন্য আমি খেলাটি দেখতে পারিনি। আমার মেয়ের করা জোড়া গোলেই বাংলাদেশ জিতেছে। এটা আমাদের গর্ব নয় শুধু, পুরো বাংলাদেশের গর্ব। এই খেলার মাধ্যমে আমার মেয়ে পুরো বাংলাদেশকে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ জেতার পর থেকেই বাড়িতে অনেক লোক এসে ভিড় করছে। আমরাও অনেক খুশি, এলাকার মানুষও খুশি।’

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের ছোট ভাই ও সুতি ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন বলেন, ‘আমাদের সুতি ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন খেলার ভেন্যু ছিল। ওই সময় কৃষ্ণা রাণী সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে খেলতে এসেছিল। তার খেলার ধরন দেখে আমার খুব ভালো লাগে। তখন থেকেই তার প্রতি খেয়াল রাখি। সে খুবই মনোযোগী ছিল। এরপর যখন কৃষ্ণা রাণী ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তখন থেকে তার প্রতি আরও বেশি খেয়াল রাখা হয়। আমাদের বিদ্যালয় থেকে কৃষ্ণাসহ বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে। আমাদের বিদ্যালয় থেকে জাতীয় আন্তস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে ছেলে-মেয়েরা খেলে পরপর তিনবারসহ মোট আট বার চ্যাম্পিয়ন হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি খেলাধুলার মানুষ। কৃষ্ণার জোড়া গোলে বাংলাদেশ জিতেছে, এটা বড় পাওয়া। তার কারণে আজ গোপালপুর তথা পুরো দেশ আনন্দিত ও গর্বিত। এত আনন্দ পেয়েছি, এটা বলার ভাষা রাখে না।’

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু বলেন, ‘আমি ২০০৯ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। ওই সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি খেলা ধরেছিলাম। তখন রবিউল নামের এক ছেলেকে টিমের প্রধান করে বাংলাদেশে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হই আমরা। ওই সময় কৃষ্ণা রানী ছিল আমাদের মেয়েদের টিম প্রধান। কৃষ্ণার বাড়ির কাছেই একটি মাঠ ছিল, তখন আমি প্রথম খেলা দেখতে যাই। সেখানে কৃষ্ণাকে একটি বল কিনে দিই। অনেক ছেলেমেয়েকে ফুটবল ও সাইকেল কিনে দিতাম। তখন অনেকেই বলতেন, “চেয়ারম্যান সাব এগুলো কী করেন?” ওই সময় মানুষ মেয়েদের খেলাধুলা ও সাইকেল চালানোর বিষয়টি অন্যভাবে দেখতো। একসময় স্কুলপর্যায়ে গ্রীষ্মকালীন ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়। ওই সময় সুতি ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আট বার বাংলাদেশে চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি প্রত্যেকটা খেলাতেই উপস্থিত ছিলাম। বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা করেছি। সোমবার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলার আগ মুহূর্তে কৃষ্ণা রাণী আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমি তাকে উৎসাহ দিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘তার এমন জোড়া গোলে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। এটা আমাদের গর্ব, পুরো বাংলাদেশের গর্ব। আমি অনেক আনন্দিত হয়েছি। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’

(এসএএম/এএস/সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test