E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ফরিদপুর পৌরসভার হালচাল: পর্ব-২

শুধু মেয়র নয়, দুর্নীতির সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির ৫ কর্মকর্তাও 

২০২৪ এপ্রিল ২৩ ১৮:৪৬:২৯
শুধু মেয়র নয়, দুর্নীতির সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির ৫ কর্মকর্তাও 

রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : বেশ কিছুদিন যাবত ফরিদপুর পৌরসভার সচেতন মহলে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে-ফরিদপুর পৌরসভা প্রশাসনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান মিয়া কি মধু পেয়েছেন ফরিদপুরে? দীর্ঘ প্রায় ১৪-১৫ বছর তিনি ফরিদপুর পৌরসভায় কর্মরত আছেন! এতোদিন কোন সরকারি কর্মকর্তার একই প্রতিষ্ঠানে একই জেলায় কর্মরত থাকা নজিরবিহীন ঘটনাই বটে। 

বাংলাদেশ সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়ে চাকরি করে আসা এই সরকারি কর্মকর্তা ফরিদপুরে থাকা অবস্থায় পেয়েছেন প্রমোশন ও বদলির আদেশ। তবুও তিনি ফরিদপুর ছাড়েননি। ফরিদপুরে তাঁর কোন বাসা ভাড়া লাগেনা। থাকেন ফরিদপুর পৌরসভার পানির ট্যাংকির জায়গায় একতলা একটি বিল্ডিংকে দোতলা বানিয়ে। অভিযোগ আছে পরিবার ঢাকায় থাকলেও তাঁর অফিসিয়াল গাড়িটি ব্যবহার করেন তাঁর ঢাকায় থাকা পরিবার। যদিও বাড়ি ভাড়া ও গাড়ির যাবতীয় খরচ তিনি নিয়মিত সরকার থেকেই নিয়ে থাকেন। সম্প্রতি ফরিদপুর পৌরসভায় ট্রপি নামে এক নারী কর্মচারি চাকরিচ্যুত হয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে এর পিছনেও হাত রয়েছে পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান মিয়ার। কি হয়েছিল ট্রপির সাথে তাঁর, কোন প্রস্তাবে রাজি হয়নি ট্রপি, কেন তিনি চাকরি হারালেন? পানির ট্যাঙ্কির ওই বাসায় রাতের বেলায় কারা যাতায়াত করেন? এসব বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে মো. শাহজাহান মিয়া জানান, 'আপনি অফিসে আসেন, সামনাসামনি কথা বলি। সব কথা তো আর ফোনে বলা যায় না'। তিনি আরও জানান, 'পানির ট্যাঙ্কির যে বাড়িতে আমি থাকি ওটা একটি পরিত্যাক্ত বাড়ি, অবশ্য বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছে'। পরিবারের কাছে সরকারি গাড়ি রাখার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা সত্য নয়।' চাকরিচ্যুত নারী কর্মচারি ট্রপি সম্পর্কে শাহজাহান মিয়া জানান, তাকে মেয়র সাহেব (অমিতাভ বোস) চাকরিচ্যুত করেছেন'।

এবার ফরিদপুর পৌরসভার হিসাব রক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডলের দিকে একটু তাকানো যাক। অমিতাভ বোস মেয়র হওয়ার পর ওএসডি থেকে ফিরে ফরিদপুর পৌরসভায় যোগদান করার পর যেন আলাদিনের প্রদীপ হাতে পেয়েছেন এই ভদ্রলোক। এখন পর্যন্ত তিনি ফরিদপুর শহরে সবচেয়ে অভিজাত এলাকা ঝিলটুলীতে একটি ফ্লাট, ফরিদপুর পুলিশ লাইন সংলগ্ন খ্রিস্টান মিশনের ভিতরে ও ফরিদপুরের খোদাবক্স রোডে কিনেছেন যায়গা। নিজের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে তার ১তলা বাড়িটি এখন ৫ তলায় পরিনত হয়েছে। কিছুদিন আগে দিল্লি, ও সম্প্রতি কাশ্মির ঘুরে এসে ভদ্রলোক এই গরমেও আছেন ফুরফুরে মেজাজে। সূত্র বলছে গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল অফিস শেষে প্রতিদিন মেয়র অমিতাভ বোসের বাসায় একটি ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করেন। সবার প্রশ্ন কি থাকে ওই ব্যাগে? নিন্দুকেরা বলেন প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে যান মেয়রের জন্য! যদি তথ্যটি সঠিক হয়, তবে এই টাকার উৎস তদন্তের দাবি রাখে বৈকি!

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল প্রথমে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, 'আমি ছাত্রনেতা ছিলাম, আমি সাংবাদিক ছিলাম। আমার বহু বন্ধু-বান্ধব সম্পাদক ইত্যাদি ইত্যাদি।' প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলতে অনুরোধ করলে তিনি জানান, 'আমার ফরিদপুর পুলিশ লাইনের পাশে খ্রিস্টান মিশনের ভিতরে জমি আছে। তবে খোদাবক্স রোডে জমির আমার নামে নয়। তাৎক্ষণিক সম্পূরক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'আপনি খোঁজ নেন।'

গোবিন্দ আরও বলেন, আপনারা অনেক কিছুই লেখেন কিন্তু, আমাকে যে সাবেক মেয়র শাস্তি দিয়েছিলেন সেটা লিখতে পারেন না'? গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল আরও বলেন, 'সাংবাদিক প্রবীর সিকদার আমাকে নিয়ে লেখে কিছু করতে পারেনি, আপনি লেখলেও আমার কিছুই হবেনা'।

এদিকে পৌরসভার ফান্ডে টাকা নাই বলে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ফরিদপুর পৌরসভার প্রায় অর্ধশত ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার কান্না জড়িত কন্ঠে এই প্রতিবেদককে জানান, 'মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হছে 'ঈদ'। আমি কাজ পেয়ে ধার-দেনা করে পৌরসভার কাজ শেষ করেছি রমজানের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে। ভেবেছিলাম বিল পেয়ে ধার দেনা পরিশোধ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে ঈদ করবো। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেটা পারিনি। মা-বাবা, বউ-বাচ্চাকে একটা সূঁতা পর্যন্ত ঈদে কিনে দিতে পারিনি। এখনও বিলের জন্য প্রতিদিন পৌরসভায় এসে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বসে থাকি, কিন্তু বিল পাচ্ছি না। কবে পাবো তাও জানিনা। পাওনাদারেরা বকাবকি করে কথা বলে। কি কবরো কিছুই বুঝতে পারছিনা'।

এদিকে গাড়ি অকশন, ভাউচার ও পুরাতন মালামাল, টেন্ডার, চাকরিচ্যুত ও নতুন নিয়োগের বিষয়ে ফরিদপুর পৌরসভার বড় কর্তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যাতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে- ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোস, উপ-সহকারি প্রকৌশলী শিমুল দাস, পরিচ্ছন্নতা কর্মকতা বিকাশ দত্ত ও হিসাব রক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডলের উপর।

এদিকে, আগে ফরিদপুরের রোড লাইটগুলো ফরিদপুর পৌরসভার দায়িত্বে ছিলো। বর্তমানে তা রোডস এন্ড হাইওয়ে একটি প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। নতুন রোড লাইট সংযোজন করেছে রোডস এন্ড হাইওয়ে। তাই পুরাতন সোলার লাইট, পাইপ, তার অপসারণ করেছে ফরিদপুর পৌরসভা। এই মালামাল গুলো পৌরসভার গোয়াটচামট পানির ট্যাঙ্কির পাশে রাখা হয়েছে। এসব নিয়েও সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া এক বছরে কি পরিমাণ ভাউচার একটি পৌরসভা করতে পারে, আর ফরিদপুর পৌরসভা কি পরিমাণ ভাউচার করছে? এসব তদন্তের দাবি রাখে। ফরিদপুর শহরের বসবাসরত অনেক সচেতন নাগরিকগণ দ্রুত এসব বিষয়ে অডিট করে দেখার দাবি জানিয়েছেন।

ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোস, উপ-সহকারি প্রকৌশলী শিমুল দাস, পরিচ্ছন্নতা কর্মকতা বিকাশ দত্ত ও হিসাব রক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল; এই চার বাবু মিলে ফরিদপুর পৌরসভাকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে নানাভাবে হরিরলুট করে যাচ্ছেন বলে অনেকেই মনে করছেন। তাই স্থানীয়রা তাদের নিয়ে একটা শ্লোকবাক্য তৈরি করেছেন, যা মানুষের মুখে মুখে হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে। শ্লোকবাক্য হলো- 'চার বাবু মিলিয়া, পৌরসভা খাচ্ছে গিলিয়া'।

ফরিদপুর পৌরসভার তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে এক ভদ্রলোক এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে পেরে (একটু উচ্চ গলায়) বললেন, 'আসিতেছে বাংলা সিনেমা- 'পৌরসভার মালি কেনো ড্রাইভার'? এ বিষয়ে পরে জানা যায়, ফরিদপুর পৌরসভায় 'মালি' পোস্টে নিয়োগ দেখানো আব্দুল হালিম নামের ওই ব্যক্তি আসলে পৌরসভার মালি নয়, বরং তিনি মেয়র অমিতাভ বোসের ড্রাইভার।

এসব যাবতীয় বিষয়ে জানতে মেয়র অমিতাভ বোসকে তাঁর মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।(চলবে..........)

(আরআর/এসপি/এপ্রিল ২৩, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test