E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দক্ষিণ উপকূলে আইলার সাত বছর পূর্তি ২৫ মে

২০১৬ মে ২৪ ১১:২৭:১৫
দক্ষিণ উপকূলে আইলার সাত বছর পূর্তি ২৫ মে

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ২৫ মে দক্ষিণ উপকূলে আইলার আঘাতের সাত বছর পূর্তি।  ভয়ংকর আইলার দানবীয় আঘাতের পর সাত বছর পার হলেও রয়ে গেছে তার ক্ষত চিহ্ণ। এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি ক্ষতিগ্রস্থ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশাশুনির প্রতাপনগরের মানুষ। তাদের রাস্তা ও বাঁধ নির্মান হয়েছে , নতুন ঘর তৈরি হয়েছে । কিন্তু এলাকায় কৃষি নেই, চিংড়ি চাষেও মন্দা। কর্মসংস্থান না থাকায় দক্ষিণের এই মানুষ কাজের সন্ধানে এখন ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ভিন্ন জেলায়।

সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নে গেলে ৯নং সোরা গ্রামের কৃষিজীবী হাসান মোল্লা, ডুুমুরিয়া গ্রামের রেজাউল করিম ও নেবুবুনিয়া গ্রামের রাবেয়া খাতুন জানান, ২০০৯ এর এই দিনে মাত্র তিরিশ মিনিটের তান্ডব নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছিল উপকূলীয় জনপদ সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দুটি ইউনিয়ন নদীবেষ্টিত গাবুরা ও পদ্মপুকুর। এ ছাড়াও বিধ্বস্ত হয় আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন। ৩৬ টি গ্রামের ৭৩ টি জীবন মুহুর্তেই কেড়ে নিয়েছিল আইলা। নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ায় গৃহহীন হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল রাস্তার ধারে ও উঁচু স্থানে । টানা দুই বছর তারা সেখানে কাটিয়ে অবশেষে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ঘর বাড়ি পেয়েছেন। কিন্তু এলাকায় কাজ না থাকা আর বারবার দুর্যোগের মুখে বসতি টিকছে না তাদের । কাজের খোঁজে বেরিয়ে যাচ্ছেন দুর্গত মানুষ।

তারা জানান, গাবুরা ইউনিয়নের ১৮ টি গ্রামে কোনো কৃষি জমি নেই বললেই চলে । আছে শুধু নোনা পাানির চিংড়ি ঘের। এসব ঘেরে কাজ হয় বছরে পাঁচ মাস। বাকি সময় তাদের থাকতে হয় বেকার। কাজের অভাবে তারা নদীতে পোনা ধরতেন। তাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আর জলদস্যু ও বাঘের মুখে সুন্দরবনে যেতে পারছেন না তারা।

তারা আরো জানান, ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই এখনো বাড়ি বানাতে পারেনি। জোয়ারের তাণ্ডবে প্রতি বছর নতুন নতুন জায়গায় নদীবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আইলায় ভেঙ্গে জমিতে বালি ভরাট হয়ে গেছে । মাছও হয়না। খাবার পানি , চিকিৎসার সুযোগও নেই। সাইক্লোন সেন্টার ও কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা যথেষ্ট কম। চার কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সারা বছর পান করতে হয়। পাত্রের অভাবে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। পুকুরের মিষ্টি পানিই দু’টি ইউনিয়নের ৭৬ হাজার মানুষের খাওয়ার পানির প্রধান উৎস। রোগ হলে দীর্ঘ এক কিলোমিটার নদীর খেয়াঘাট পার করে ৩০ কিলোমিটার দুরে শ্যামনগরে বা ৮০ কিলোমিটার দূরে সাতক্ষীরা শহরে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু নদী খালের এলাকা হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ।

শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের শওকত আলী ও গৃহবধু নূরজাহান বেগম জানান, বেশিরভাগ এলাকা লবনাক্ত। এ এলাকা এক ফসলী। ফলে বছর জুড়ে কৃষি কাজের সুযোগ না থাকায় তারা গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে চলে যান বাইরে। আগে তারা বনে যেতেন । এখন ডাকাতদের উৎপাত আর বাঘের ভয়ে বনে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া আগে নদীতে বাগদার রেনু ধরে সংসার চালানো যেতো। এখন সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও পেটের জ্বালায় কোষ্ট গার্ড ও বনভিাগের চোখ এড়িয়ে নদীতে নামতে হয় বাগদার রেণু ধরতে। এ ছাড়া এলাকার অনেকই ঢাকা, আমিনবাজার, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন ইটভাটায় ছয় মাস করে কাজ করে থাকে। কেই কেই শহরে রিক্সা চালায়। বাকি সময়ে তারা এলাকায় ফিরে এসে দিন মজুর খেটে কোন প্রকারে সংসার চালায়।

এলাকার গরীব মানুষের জীবনযাত্রার চরম দুর্দশার কথা তুলে ধরেন আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহনিয়া গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান। তিনি জানান, সুভদ্রকাটি, রুইয়ার বিলসহ কয়েকটি গ্রামের মানুষ আইলার পর থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তাছাড়া ২০১২ সালে জলবায়ু ট্রাষ্টের আওতায় প্রতিটি চার লাখ টাকা ব্যয়ে আইলা দুর্গত মানুষের জন্য ৪০০টি গৃহনির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও জেলা পরিষদের অনিয়ম ও দূর্ণীতির ফলে উচ্চ আদালতে কয়েকটি রিট পিটিশন দাখিল হওয়ায়ূ ওই কার্যক্রম একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া প্রতিবছর কয়েকবার নদীবাঁধ ভাঙনের ফলে নতুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে এলাকা ছাড়ছে মানুষ।

গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান আলি আযম টিটো জানান, দক্ষিণ পঞ্চিমাঞ্চলের আইলা দুর্গত এলাকা গাবুরা ও পদ্মপুকুরের মানুষের জীবন ধারনের সব সুযোগ হারিয়ে গেছে। চিকিৎসা নেই। প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট সংখ্যক সাইক্লোন শেল্টারও নেই। লেখাপড়ার সুযোগ কম। কর্মসংস্থানের সূযোগ নেই। শিশু চিকিৎসার সুবিধাও অনুপস্থিত। প্রতি বছর ভাঙছে নদী বাঁধ। ফলে এলাকা ছাড়ছে সাধারণ মানুষ। এসব কারণে জনবসতি স্থায়ী হচ্ছে না গাবুরা ও পদ্মপুকুরে। গোখাদ্যের অভাব এবং মাটি ও পানি লবনাক্ত হওয়ায় গবাদি পশু পালনও কঠিন এ এলাকায় । গাবুরা ইউনিয়নে বর্তমানে ছয় হাজার ৮০০ পরিবারে জনসংখ্যা ৪৩ হাজার। ২০০৯ সালে গাবুরায় যে জনসংখ্যা ছিল বর্তমানে তা অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এলাকাবাসীর আর্থ সামজিক উন্নয়নে সরকারকে বড় ধরণের প্রকল্প হাতে নেওয়ার আবেদন জানান তিনি।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সায়েদ মোঃ মঞ্জুর আলম জানান,ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ নির্মান করা হলেও তা যথেষ্ট মজবুত নয়। নতুন করে ভাঙন প্রতিরোধে চাই নতুনপ্রযুক্তি । অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগনকে বাঁধ সংস্কারে সম্পৃক্ত করতে হবে। সুপেয় পানি ও কর্মসংস্থানের কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনবল সঙ্কটের কারণে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বাইরে থেকে লোক এনে কাজ করাতে হয়। কারণ রিমোর্ট এলাকায় বদলী হয়ে আসার কিছু দিনের মধ্যে তারা অন্যত্র বদলী হয়ে যায়। কর্মসংস্থানের জন্য কাঁকড়া মোটা তাজাকরণসহ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।


(আরএনকে/এস/মে ২৪,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test