E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

খেচাউপাড়া গ্রামে শিক্ষার বাতিঘর সেকান্দার সিকদার

২০১৮ এপ্রিল ২২ ১৭:১১:৫০
খেচাউপাড়া গ্রামে শিক্ষার বাতিঘর সেকান্দার সিকদার

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামী, কুশিক্ষা, ফকিরের কুফরিতে বিশ্বাস করে হাজারো মানুষ তখন ছিলো অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত। অভার ও স্কুল না থাকায় অভিভাবকরাই যখন কর্মের দিকে ঠেলে দিতো শিশু-কিশোরদের। যে গ্রামে ভোর হলে স্কুল ব্যাগ নিয়ে ছুটতে দেখা যেতো না কোন শিশুকে। এ চিত্র ১৯৯৩ সালের পূর্ববর্তী। আজ থেকে ২৫ বছর আগের। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার খেচাউপাড়া গ্রামের।

২০১৮ সালে এই খেচাউপাড়া গ্রামে এখন প্রায় শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। অশিক্ষার অন্ধকার দূর হওয়ায় কেটে গেছে সকল গোঁড়ামী। ২৫ বছরে এই অশিক্ষায় অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামকে শিক্ষায় আলোয় অলোকিত করে প্রতিটি ঘর অলোকিত করেছেন একজন শিক্ষানুরাগী। নাম সেকান্দার সিকদার (৮৬)। সবার প্রিয় সেকান্দার চাচা।

১৯৯০ সালে মাত্র ৫০ শতক জমির মালিক ছিলেন এই সেকান্দার সিকদার। পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ের সংসারে অভাব তখনও তাঁর নিত্যসঙ্গী। খেচাউপাড়া গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় উচ্চ শিক্ষায়
শিক্ষিত করতে পারেণ নি কোন সন্তানকেই। অশিক্ষায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এই গ্রামকে ঝড় জলোচ্ছাস থেকে মানুষকে রক্ষার জণ্য এনজিও কারিতাস একটি আশ্রয় কেন্দ্র করার উদ্যেগ নেয়। কিন্তু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কেউ জায়গা দিতে চায়নি গোঁড়ামীর কারণে। এগিয়ে আসে সেকান্দার সিকদার।

এলাকার মানুষের কথা চিন্তা করে ১৯৯১ সালে দান করেণ ৪০ শতক জমি। সেই জমিতে সাইক্লোন সেল্টার নির্মান হওয়ার পর ১৯৯৩ প্রতিষ্ঠিত হয় খেচাউপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯৫ সালে রেজিষ্ট্রেশন পাওয়ার ১৮ বছর পর ২০১৩ বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ১৩৭ জন। পাঁচজন শিক্ষকের পদ থাকলেও বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক আছে তিনজন।

শিক্ষানুরাগী সেকান্দার সিকদার নিজে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হলেও গত ২৫ বছরে তাঁর দান করা জমিতে প্রতিষ্ঠিত খেচাউপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষার সুযোগ
পেয়ে আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

বয়স ৮৬ হলেও এখনও খালে মাছ শিকার, রাস্তার মাটি কাটা কিংবা শ্রম বিক্রি করে চলতে হচ্ছে সেকান্দার সিকদারকে। কিন্তু এতে তাঁর কোন আক্ষেপ নেই। বরং ভোর হলেই এখনও সে স্কুল মাঠে গিয়ে খোঁজ নেন দরিদ্র শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের। দারিদ্রতার কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করলেও শিক্ষা পাগল এই মানুষটি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়ান। তাদের সহায়তার চেষ্টা করেণ।

খেচাউপাড়া গ্রামের বেড়িবাঁধের পাশে একটি ছোট্র ঘরে বাস করেণ এই অলোকিত মানুষ সেকান্দার সিকদার।

তিনি জানালেন, স্কুলের জণ্য জায়গা দিয়ে যখন চরম দারিদ্রতার মধ্যে ছিলেন তখন, কলাগাছ সেদ্ধ করে
খেয়েছেন। লোনা পানির কারণে এক কানি (আট বিঘা) জমিতে দুই মণ ধানও পাওয়া যায়নি। এক পট চালের সঙ্গে ১০ পট কলাই ডাল মেশানো ভাত খেতেন। চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সেই যে যুদ্ধ শুরু
করেছিলেন সেই জীবনযুদ্ধ এখনও চলছে তার।

সেকান্দার সিকদার নিজে ও ছেলে-মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। কিন্তু নাতি-নাতনিদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। কেউ মাধ্যমিকে, কেউ আবার প্রাইমারিতে পড়ছে। সংসারে দু’মুঠো ভাতের জণ্য এখনও রাতভর মাছ ধরেন। কখনও কখনও রাস্তার মাটি কাটেন। দৈনিক শ্রম বিক্রি করেণ।

তিনি বলেন, এখন গড়ে প্রতিদিন দুই-আড়াই শ’ টাকার মাছ বিক্রি করেন। এতেই চলে সংসার। সময় পেলে স্কুলের বাড়ান্দায় বসে ভবিষৎ প্রজন্মের শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে সময় কাটান এবং শুনেন তাদের স্বপ্ন।
যে স্বপ্ন আগে তিনি দেখতেন।

সেকান্দার সিকদারের স্বপ্নে গড়া খেচাউপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাশ করা বহু শিক্ষার্থী আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয় না এই স্বপ্ন কারিগরের। নিজে আধাপেটা খেয়ে, শ্রম বিক্রি করে সংসার চালালেও স্কুলের কাছে কিছুই চান নি দুঃসময়েও। কিন্তু এই বার্ধক্যে এসে তাঁর শেষ স্বপ্ন ও চাওয়া এই বিদ্যালয়ে তাঁর পরিবারের কাউকে স্কুলের সহায়ক কিংবা নাইটগার্ডের কোন পদে চাকরি দেয়া হোক। এতেই তাঁর তৃপ্তি।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহাতাব উদ্দিন বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয়ের আধুনিক ভবন। সেকান্দার সিকদারের কারণেই আজ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এলাকার মানুষ শিক্ষার অলোয় আলোকিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের সাইক্লোন সেল্টারটি যখন পরিত্যক্ত হয়ে যায় তখন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া হুমকির মুখে পড়ে। বন্ধ হতে চলা বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে সেকান্দার সিকদার নিজের জীর্ণ ঘরের বাড়ান্দা ছেড়ে দেন। তাঁর ঘরের বাড়ান্দায় তিন বছরেরও বেশি চলে এই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।

সমাজকে আলোকিত করা গ্রামীন শিক্ষার এই বাতিঘর সেকান্দার সিকদারকে খুঁজে পেয়েছেন কলাপাড়ার সাংবাদিক মেজবাহউদ্দিন মাননু।

তিনি বলেন, লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতে ভালবাসেন এই দানবীর। বার্ধক্যে গুটিয়ে যাওয়া মানুষটির কারণে এই খেচাউপাড়া আজ শিক্ষায় আলোকিত। কিন্তু তার এই মহান কর্মের খবর কেউ নেয়নি
এতোদিন। তাঁকে রাস্ট্রীয়ভাবে সন্মানিত করা উচিত।

কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার বলেন, শিক্ষানুরাগী এই মানুষটি শিক্ষায় যে অবদান রেখেছেন এজণ্য তাঁকে সন্মানিত করা উচিত। আমরা চেষ্টা করবো তাঁকে সন্মানিত করার। তাঁর অবদান সবাইকে জানানো উচিত। এতেই মানুষ উদ্ধুদ্ধ হবে। জানতে পারবে সমাজের কীর্তিমানদের কথা।

(এমকেআর/এসপি/এপ্রিল ২২, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test