E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিয়ালী গ্রামে থমথমে অবস্থা

২০২১ আগস্ট ২০ ১৯:৩৪:২৩
শিয়ালী গ্রামে থমথমে অবস্থা

রঘুনাথ খাঁ, খুলনা থেকে ফিরে : ইমামের দাঁড়ি ছিঁড়ে নেওয়া ও মসজিদ ভাঙচুরের অপপ্রচার করে  গত ৭ আগষ্ট বিকেলে খুলনার রুপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের গোয়াড়া মহাশ্মশানমন্দির, শিয়ালী গ্রামের ১১টি মন্দির, মন্দিরের প্রতিমা, দু’টি বাড়ি, সাতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান  ও একটি ক্লাব ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ঘটনার পরবর্তী র‌্যাব ও পুলিশ ১৬জনকে গ্রেফতার করলেও আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দলের কিছু কর্মী সমর্থক ওই এলাকার হিন্দুদের হুমকি দেওয়ায় অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। সন্ধ্যার পর বের হচ্ছেন না রাস্তায়।

সরেজমিনে শুক্রবার সকালে শিয়ালী মলি­কপাড়ায় গেলে কর্ণধর মলি­ক, অশোক ধর রীতা মলি­কসহ কয়েকজন জানান, মহামারী করোনা ও গ্রামে সমপ্রতি কয়েকটি অপমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গত ২ আগষ্ট রাতে স্বপ্ন দেখেন তাদের গ্রামের কৃষ্ণ ব্যাপারির স্ত্রী শিলা ব্যাপারী। তিনদিন ধরে এলাকায় হরিনাম সংকীর্তণ করলে করোনা ও অপমৃত্যুর হাত থেকে গ্রামের মানুষ রক্ষা পাবে বলে স্বপ্নাদেশ হয়। সে অনুযায়ি ৫ আগষ্ট বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যার পর মলি­কপাড়ার ২৫/৩০ জন নারী ও পুরুষ হরিনাম করতে করতে মধ্যপাড়া হরিমন্দির থেকে বের হয়ে শিয়ালী বাজারের পাশে গোয়াড়া- শিয়ালী মহাশ্মশানের দিকে রওনা হন। শিয়ালী বাজারের নিকটে এসে দাইপাড়ার সামনে রাস্তায় পৌঁছালে দাইপাড়ার মাসুম , দুরুল ইসলাম, লিটনসহ কয়েকজন তাদেরকে হরিনাম গাইতে মানা করে। মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে কীর্তন করা যাবে না বলে হুশিয়ারি দেওয়া হয়। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরপর রণজিৎ মজুমদারের বাড়িতে মহাপ্রভুর মালসা ভোগের অনুষ্ঠানে যান তারা। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে বিষয়টি উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শক্তি পদ বসু, ইউপি সদস্য মনি মালাকারসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অবহিত করা হয়। পরদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে শক্তিপদ বসুর নেতৃত্বে ৩০/৪০ জন হরিনাম সংকীর্তণ করতে দাইপাড়ার সামনের রাস্তায় গেলেন আবারো দাই পাড়ার কয়েকজন মুসলিম তাদেরকে কীর্তণ বন্ধ করতে বলে। এ সময় উভয়ের মধ্যে হাতহাতি হয়। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে শিয়ালী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক লিটনকে জানানো হয়। তিনি এসে উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলেন ছুটিতে থাকা রুপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। একপর্যায়ে ৮ আগষ্ট রোববার উভয়পক্ষকে নিয়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলোচনায় বসার দিন ধার্য করেন। যদিও দাইপাড়ার লোকজন সেটি মানতে চায়নি। রাতে পার্শ্ববর্তী চাঁদপুর হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি উগ্রবাদি কয়েকজন মুসলিম একত্রিত হয়ে মলি­কপাড়ায় হামলার পরিকল্পনা করে। বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করা হয়।

গোয়াড়া- শিয়ালী মহাশ্মশান পরিচালনা কমিটির প্রচার সম্পাদক অপূর্ব হালদার জানান, ৭ আগষ্ট শনিবার বিকেল তিনটার দিকে চাঁদপুর গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিএনপি জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের দেড় হাজারের বেশি কর্মী সমর্থক শিয়ালী বাজারে আসে। এ সময় তারা নিপুন ধর ওরফে শিব ধরের বিরুদ্ধে দাইপাড়া জামে মসজিদের ইমাম নাদিম দফাদারের দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়া ও মসজিদ ভাঙার অপ্রপচার দেয়। তাদের হাতে দা, কুড়াল, লোহার রড, বাঁশের লাঠিসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ছিল। এ সময় তারা আঠারবাকি নদীর ধারে মহাশ্মশানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে তারা শ্মশান মন্দিরের দরজা ভেঙে প্রতিমা ভাঙচুর করে। লুটপাট করা হয় মন্দিরের জিনিসপত্র ও প্রণামীর টাকা। এরপর তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ দিয়ে শিয়ালী গ্রামের মধ্যপাড়ার মধু মলি­কের হরিমন্দিরে এসে হামলা চালায়। ভাঙচুর করা হয় মন্দিরের দরজা ও প্রতিমা। এরপর হামলাকারিরা নিপুন ধর ওরফে শিব ধরের খুন করতে হবে এমন কথা উল­াস করতে করতে পূর্বপাড়ায় আসার পথে একে একে প্রভাষ মলি­কের মুদি দোকান, গণেশ মলি­কের ঔষধের দোকান, অনির্বাণ হীরার চায়ের দোকান, প্রীতম মজুমদারের ম্যাশিনারিজের দোকান, পূর্বপাড়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, তারণ্য দীপ্ত একতা সংঘ, সার্বজনীন কালীমন্দির, দুর্গা মন্দির, হরিমন্দির (২) ও রাধা গোবিন্দ মন্দিরসহ ১১টি মন্দির ও মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে। ভাঙচুর শেষে লুটপাট করা হয় মোট সাতটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ও একটি ক্লাবে।

শিয়ালী মলি­কপাড়ার শেফালী ধর জানান, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে মধ্যপাড়ার কয়েকটি মন্দির, ক্লাব ও দাকান ভাঙচুর শেষে হামলাকারিরা তাদের বাড়ির দিকে আসছে এমন খর পেয়ে তার বড় ছেলে নিপুর ধর ওরফে শিবু, তার স্ত্রী পলি ধর ও ছেলে গোপালকে তড়িঘড়ি করে পার্শ্ববর্তী বিনয় ঋষি ও তার ভাইয়ের বাড়ির শৌচাগারে লুকিয়ে রাখা হয়। হামলাকারিরা আসার আগেই তিনিসহ ছোট ছেলে নিশিথ ধরসহ বাড়ির অন্যরা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেন। একপর্যায়ে হামলাকারিরা তার স্বামীর সমাধি, পারিবারিক রাধাগোবিন্দ মন্দির, শৌচাগার, টিউবওয়েল ও বসত ঘরের গ্রীলের তালা ও দরজা ভেঙে ঘরের মধ্যে ঢোকে। আলমারির ভেঙে তারা ড্রয়ারে থাকা এক লাখ ৬৪ হাজার টাকা ও ছয় ভরি সোনার গহনা লুট করে। রান্না ঘরে ভাতের হাঁড়িতে লাথি মেরে উঠানে ফেলে দেয়। কবুতরের বাক্স ভেঙে ৫৫ জোড়া কবুতর নিয়ে যায় তারা। মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর শেষে ঘরের মধ্যে থাকা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুট করে তারা। পরে ছেলে শিব পালিয়ে আছে ভেবে তাদের পিছনের শীতল বাড়–ই এর বাড়ি ভাঙচুর করে হামলাকারিরা।

তারুণ্য দীপ্ত একতা সংঘের সাধারণ সম্পাদক মনোজিৎ বিশ্বাস, সুধাময় মালাকার, ইউপি সদস্য মনি মালাকার, ঘাটভোগ ইউপি চেয়ারম্যান সাধন অধিকারীসহ কয়েকজন জানান, এক স্কুলের দপ্তরী শিব দাইপাড়া মসজিদের ইমামকে সম্মানহানি করেছে প্রচার দিয়ে কৃষক শিব ধরের বাড়ি, মন্দির ও তার বাবার সমাধি ভাঙচুর করেছে। যেভাবে পুলিশের উপস্থিতিতে মন্দির, প্রতিমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব ও বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে তা যে কোন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। এখন ওই হামলাকারিরা আওয়ামী লীগ সরকার চলে গেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেখে নেওয়া হবে বলে হুমকি দিচ্ছে।

তারা আরো জানান. গত ৯ আগষ্ট খুলনায় অবস্থানরত ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনারের প্রথম সেক্রেটারী রাজেশ রায়নাসহ খুলনা জেলা প্রশাসক, খুলনা পুলিশ সুপার, খুলনা রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক ড. খন্দকার মুহাঃ মুহিতউদ্দিন, নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত নিম চন্দ্র ভৌমিক তাদের এলাকা পরিদর্শণ করেছেন।

গত বৃহষ্পতিবার ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক, সাংসদ আক্তারুজ্জামান বাবু, সাংসদ সালাম মুর্শিদ, সাংসদ নারায়ণ চন্দ্র চন্দসহ কয়েজন রাজনৈতিক নেতা ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছেন। পুলিশ টহলে থাকার পরও তারা সন্ধ্যার পর এলাকার বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। মামলা করার পর বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে ৭৪ জনের নাম তারা জানতে পেরেছেন। যাদের নামে নতুন করে সম্পুরক মামলা দেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রুপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় শক্তিপদ বসু বাদি হয়ে চাঁদপুর গ্রামের ২৫ জনের নাম উলে­খসহ অজ্ঞাতনামা ১৫০ জনের বিরুদ্ধে গত ৮ আগষ্ট থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এ পর্যন্ত ১৬জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৩ জনের প্রত্যেককে সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন করে দু’ দিন করে মঞ্জুর হয়। জিজ্ঞাসাবদ শেষে তাদেরকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষে আটককৃত তিনজনকে সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন জানানো হলেও এখন বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত রিমাণ্ড শুনানী হয়নি। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারেরর চেষ্টা চলছে। রিমাণ্ডে জিজ্ঞাসাবদ শেষে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।

রুপসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এলাকায় পুলিশ টহল অব্যহত রয়েছে।

(আরকে/এএস/আগস্ট ২০, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test