E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কার্বন কারখানার বিষাক্ত ধোয়ায় অতিষ্ঠ অচিন্তনগরের মানুষ

২০২৩ মে ১৪ ১৫:২৪:৪১
কার্বন কারখানার বিষাক্ত ধোয়ায় অতিষ্ঠ অচিন্তনগরের মানুষ

স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ : বিকাল সাড়ে পাঁচটা, চুল্লিগুলো থেকে দুর্গন্ধ যুক্ত ধোয়া বের হয়ে বাতাসে মিশে ছড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশের এলাকায়। বছরের পর বছর ধরে আবাসিক এলাকায় পরিবেশ ছারপত্র ছাড়া এভাবেই তাজী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড কারখানায় চুল্লিতে পাটকাঠি পুড়িয়ে কার্বন ছাই তৈরির সময় বের হয় ধোয়া। যা চলে ভোররাত পর্যন্ত। এই ধোয়া আর দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা। স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে মানুষের। তবুও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ কারখানার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ কারখানার কারণে ওই অঞ্চলের বায়ুদূষণের মাত্রা কয়েক গুন বেড়েছে।

সরেজমিন ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পদ্মকর ইউনিয়নের অচিন্তনগর গ্রামে গড়ে ওঠে তাজী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামে এ কারখানাটি। স্থাপনের সময় গ্রামবাসীকে তাঁরা বলেছিল কারখানায় পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন তৈরি করা হবে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, কোনো ধোয়া হবে না। তিন বছর পর কারখানা অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু আজও তা করা হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

এ দিকে কারখানাটিতে বিকাল থেকে ভোর রাত পর্য়ন্ত পাটকাঠি পোড়ানোর ধোয়ায় ছেয়ে যায় গ্রামটি। যার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ওই এলাকায়। বাড়িঘরে পড়ছে কয়লা, কালো ধুলার আস্তরণ। এমনকি কমেছে আশপাশের ফসলি জমির উৎপাদনও। সাধারণত বড় বড় চুল্লিতে আগুন দিয়ে দরজা বন্ধ করে পাঠকাঠি হালকা পুড়িয়ে সেটি ঠান্ডা করা হয়। পরে মেশিনে ক্রাশিং করে তৈরি করা হয় কার্বন বা ছাই। আর সেটি বস্তা বন্দী করে পরবর্তীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চীনে। এটি ব্যবহার হয় প্রিন্টারের কালি, মেকআপ, কার্বন সহ বিভিন্ন কাজে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারখানাটিতে নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, বাস্তবায়ন করা হয়নি ফায়ার সেফটি প্লান। তবুও বছরের পর বছরর ধরে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় পাঠকাঠি পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে কার্বন ও ছাই। পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা না থাকায় ২০১৪ সালের পর ৩ বার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে দগ্ধ হন ফায়ার সার্ভিসের দুই কর্মী ও চীনা নাগরিকসহ ৬ জন। দীর্ঘদিন এমন অব্যবস্থাপনা চললেও তার দিকে সঠিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে মেলেনি কোন পদক্ষেপ। এমনকি কারখানা কর্তৃপক্ষের ভয়ে কিছু বলতেও সাহস পায়না স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ঝিনাইদহ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্রীরুপ মজুমদার জানান, কারখানাটির কোন ছাড়পত্র নেই। আমি সেখানে কয়েকবার পরিদর্শন করেছি। কয়েক দিন আগেও গিয়েছিলাম সঠিক ভাবে কারখানা চালাতে বলে এসেছিলাম।

এ দিকে ছাড়পত্র না থাকলেও কারখানা ম্যানেজার কামরুল হাসান বলেন, জেলা কার্যালয় থেকে ছাড়পত্র না পেলেও তাদের অনাপত্তিপত্র নেওয়া হয়েছে কারখানাটি চালানোর জন্য। তবে তিনি এই অনাপত্তিপত্রটি দেখাতে রাজি হননি।

যদিও পরিবেশ অধিপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, ছাড়পত্র ছাড়া কোনভাবেই অনাপত্তিপত্র দেওয়া সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ মিথ্যা কথা বলেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আতিয়ার রহমান জানান, যখন পাঠকাঠি পুড়ায় তখন প্রচুর ধোয়া বের হয়। নি:শ্বাস নেওয়া কষ্ট হয়ে দাড়ায়। বিকট গন্ধ হয় এলাকায়। বেশী সমস্যা হয় কারখানার আশপাশের বসবাসকারী মানুষের। বাড়িতে ধুলায় টেকা যায়না।

এতো অত্যাচার তবুও ভয়ে কিছু বলতেও সাহস পাইনা। কিছু বললেই কারখানার লোকজন স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ে বাড়িতে এসে ভয়ভীতি দেখায়।

পদ্মাকর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিকাশ কুমার বিশ্বাস জানান, এই প্রতিষ্ঠানে যখন পাটকাঠি পোড়ে তখন ধোয়া যেদিকে যায় সেখানকার মানুষ টিকতে পারেনা। দুর্গন্ধ, ধোয়ায় শ্বাসকষ্ট হয়। এলাকার মানুষ অনেক কষ্টে আছে। কাউকে এ বিষয়ে বলেও কোন কাজ হয়নি।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের বক্ষব্যাধী মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা: এস এম আশরাফুজ্জামান সজীব জানান, পাটকাঠি আংশিক পোড়ালে কার্বন মনোক্সাইড এবং ধূলিকনা বের হয়। শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে হাপানী রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এমন কি ধুলি জমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতাও কমতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ক্রনিক ব্রংকাইটিস ও ইন্টার স্টিশিয়াল লাং ডিজিজি এ আক্রান্তের শঙ্কাও থেকে যায়। অনেক সময় অক্সিজেন বন্ধ হলে হাইড্রো কার্বন জাতীয় বাতাস বের হয় যা ফুসফুস ক্যানসারের জন্য দায়ী।

বিষয়টি নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ঝিনাইদহের দায়িত্বে থাকা ওয়্যার হাউজ ইন্সপেক্টর লুৎফর রহমান জানান, এই কারখানাটি ফায়ার লাইসেন্স থাকলেও ফায়ার সেফটি প্লান বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি তাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে বলা হলেও আগ্রহ দেখায়নি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফায়ার সার্ভিসের যতটুকু করনীয় সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে তাজী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড কারখানাটির সহকারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের ভুইয়া জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই পেয়ে যাবো। এখানে অগ্নি নির্বাপনের সকল ব্যবস্থা রয়েছে। ফায়ারের অফিসার বলেছে আমাদের প্রশিক্ষণ নেই। সে কি বোঝে প্রশিক্ষণ কি। এখানে পাটকাঠি কিনে পোড়ানো হয়। গ্রামের মানুষ কাজ করে । এছাড়া এই এলাকার কৃষি পণ্যের সহজ বিক্রি করতে পারে কৃষক।

এ ব্যাপারে জানতে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলামকে একাধিক বার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

(একে/এএস/মে ১৪, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test