E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে খাদ্য বিভাগে সীমাহীন দুর্নীতি !

২০১৫ জুন ১৬ ১৬:২৮:৫১
শরীয়তপুরে খাদ্য বিভাগে সীমাহীন দুর্নীতি !

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : সরকারিভাবে কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদন মৌসুমে গম, ধান ও চাউল ক্রয়ে সকল দুর্নীতির রেকর্ড ছাড়িয়েছে শরীয়তপুরের খাদ্য বিভাগ। তারা লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ খেয়ে বঞ্চিত করছে শরীয়তপুরের ধান-গম চাষী কৃষকদের।  সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে খাদ্যশস্য ক্রয়ের বিধান থাকলেও তা ক্রয় করা হয়েছে ফড়িয়া, মধ্যসত্বভূগি বেপারী, দালালচক্র ও কালোবাজারি সিন্ডিকেটের কাছ থেকে।

অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, মাঠ পর্যায়ে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাযোসে সৃষ্টি হওয়া দুর্নীতির চিত্র। এদিকে সময়মত ধান সংগ্রহ না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন কৃষক ও কৃষি বিভাগের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা। গণমাধ্যম কর্মীরা খাদ্য কর্মকর্তাদের কাছে মাসের পর মাস ঘুরে, তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী আবেদন করেও খাদ্যশস্য ক্রয়ের তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করতে রাজি হন না কর্তৃপক্ষ।
জেলা খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সরকার শরীয়তপুর জেলার ৬ উপজেলা থেকে ন্যায্যমূল্যে প্রতি কেজি ২৮ টাকা দরে সাড়ে ১২ লক্ষ কেজি গম, ২২ টাকা দরে ৬ লক্ষ ৫১ হাজার কেজি ধান ও ৩২ টাকা দরে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার কেজি সিদ্ধ চাউল ক্রয় করবে। এ অনুযায়ী খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে দেশ ব্যাপি ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত গম ক্রয় এবং ১ মে থেকে ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত বোরো ধান ও সিদ্ধ চাউল ক্রয় করার। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী ইতিমধ্যে গম ও চাউল ক্রয় সম্পন্ন করেছে জেলা খাদ্য বিভাগ। উৎপাদন সময়ে ধানের বাজার গত দশ বছরের তুলনায় সর্ব নিম্ম দর থাকলেও আজ পর্যন্ত ধান ক্রয় শুরু করেনি খাদ্যগুদাম গুলো। জানা গেছে, কালো বাজারি চক্র বরিশাল থেকে নিন্ম মানের ধান ক্রয় করে আনার পরই খাদ্য বিভাগ কৃষকদের বাদ দিয়ে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ধান গ্রহন করবে।
এবছর জেলার সদর উপজেলা থেকে ২ শত ২৮ মেট্রিক টন গম, ১ শত ৩৩ মেট্রিক টন ধান ও ২ শত ২ মেট্রিক চাউল, ডামুড্যা উপজেলা থেকে ১ শত ৩৪ মেট্রিক টন গম, ১ শত ৫ মেট্রিক টন ধান, ১ শত ৭৮ মেট্রিক টন চাউল, গোসাইরহাট উপজেলা থেকে ১ শত ৪৭ মেট্রিক টন গম, ১ শত ১৮ মেট্রিক টন ধান, নড়িয়া উপজেলা থেকে ৪৮ মেট্রিক টন গম, ১ শত ৫০ মেট্রিক টন ধান, ভেদরগঞ্জ উপজেলা থেকে ৪ শত ২৪ মেট্রিক টন গম, ১ শত ২০ মেট্রিক টন ধান এবং জাজিরা থেকে ২ শত ৬৯ মেট্রিক টন গম ও মাত্র ২৫ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে। কিন্তু নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, গোসাইরহাট ও জাজিরা উপজেলা থেকে কোন চাউল ক্রয়ের সদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়নি।
সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে জানা গেছে, ধান ও গম ক্রয়ের পূর্বে খাদ্য বিভাগের লোকেরা এলাকায় ব্যাপকভাবে মাইকিং এর মাধ্যমে প্রচার করে, খাদ্য গুদামের সমানে ও বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ব্যানার টাঙ্গিয়ে ও কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে গম-ধান ক্রয় শুরু করবে। প্রতি এক জন কৃষক ৫০ কেজি থেকে শুরু করে ৩ হাজার কেজি পর্যন্ত গম ও ধান বিক্রি করার নিয়ম রয়েছে। বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। উপজেলা ভিত্তিক আওয়ামীলীগের নেতা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বারে, স্কুল শিক্ষক এমনকি মাদক ব্যবসায়ীরা মিলে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকা ঘুষ খাইয়ে খাদ্য গুদামে রাতের অন্ধকারে ট্রাক, ট্রলি, নসিমন, ভটভটিতে করে গম সরবরাহ করেছে। কোন কৃষকের কাছ থেকে এক তোলা পরিমানের গমও ক্রয় করা হয়নি। উপসহাকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তাদের থেকে চাষি সনদ গ্রহন করে শত শত অকৃষিজীবী কাল্পনিক মানুষের নাম দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩ হাজার কেজি করে গম ক্রয়ের প্রমানপত্র সংরক্ষণ করেছে। সবচেয়ে বড় দুর্নীতি ধরা পরেছে জেলার ভেদরগঞ্জ ও সদর উপজেলা খাদ্য গুদামে।
গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকতারা দায়িত্ব নিয়ে এ দুর্নীতিতে সহায়তা করেছে। বিনিময়ে প্রতি ১ টন গমের বিপরীতে ২ হাজার টাকা, চাউলের বিপরীতে ৪ হাজার টাকা ও ধানের বিপরীতে ২ হাজার টাকা করে উৎকোচ গ্রহন করেছে খাদ্য কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য বিভাগের কয়েকজন কর্মচারী ও ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ঘুষের এই টাকা খাদ্য গুদামের ঝাড়–দার থেকে শুরু করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এর ভাগ পেয়ে থাকেন। আরো জানা যায়, ঘুষের এই টাকা বন্টন করেন সদর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা এবং একই সাথে জেলার অপর ৫ উপজেলারও দায়িত্বে থাকা কাজী গোলাম কিবরিয়া।
শরীয়তপুর সদর উপজেলায় ২ লক্ষ ২ হাজার কেজি চাউল ক্রয়ের জন্য স্থানীয় আঙ্গারিয়া বাজারের ৬ টি রাইস মিলের সাথে খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ চুক্তি করে। মিলগুলো হলো হাবিব রাইস মিল, সততা রাইস মিল, শিকদার রাইস মিল, ভাই ভাই রাইস মিল, মোল্যা রাইস মিল এবং খান রাইস মিল। ৬টি রাইস মিলের বেশীর ভাগই রয়েছে বন্ধ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকদের কাছ থেকে কোন চাউল ক্রয় না করে, দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে কম দরে নিন্ম মালের চাউল কিনে ট্রাক ভরে এনে রাতের অন্ধকারে খাদ্য গুদামে সরবরাহ করেছে। জেলা সদরের আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খলিলুর রহমান রাতে-দিনে সেই চাউল গ্রহন করে খাদ্য গুদামে মজুত করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ২৯ হাজার ১ শত ১০ হেক্টর জমিতে ৯৪ হাজার ১ শত ২ জন কৃষক ধান আবাদ করে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ২ শত মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করেছে। যা থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজার ৩ শত ৫০ মেট্রিক টন চাউল উৎপাদন হয়েছে। অপর দিকে জেলার ৬ উপজেলায় ২৭ হাজার ৪ শত ৪৬ জন কৃষক ৩ হাজার ৭ শত ১৪ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ করে ফলন পেয়েছেন ১৪ হাজার ২ শত ৯৯ মেট্রিক টন। কিন্তু খাদ্য বিভাগ কোন কৃষকের থেকেই গম ক্রয় করেনি। ধান ক্রয় করেবন বলেও মনে হচ্ছে না। সময়মত ধান সংগ্রহ না করার কারনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার অসংখ্য কৃষক ও কৃষি বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
জেলার ডামুড্যা উপজেলার দশমন তারা গ্রামের গম চাষি মাইনুদ্দি দেওয়ান বলেন, আমি এবছর ২ একর জমিতে গমের আবাদ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে প্রতি কেজি গম ২০ টাকার বেশী বিক্রি করতে পারিনি। তাই ২৮ টাকা করে খাদ্য গুদামে সরকারীভাবে গম ক্রয়ের কথা শুনে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ডামুড্যা খাদ্য গুদামে যোগাযোগ করলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে জানিয়ে দেন এবছর গম ক্রয় শেষ হয়ে গেছে, এখন আর গম নেয়া যাবেনা।
সদর উপজেলা স্বর্নঘোষ গ্রামের সামসুল হক মোল্যা বলেন, আমার ক্ষেতের উৎপাদিত ৫০ মন গম আমি মে মাসের মাঝামাঝি দিকে আঙ্গারিয়া খাদ্যা গুদামে বিক্রি করতে চাইলে গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খলিলুর রহমান সাফ জানিয়ে দেন অনেক আগেই গম কেনা হয়ে গেছে। অতিরিক্ত বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছি, পাওয়া গেলে পরে বিবেচনা করে দেখবো।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার আটং, পাটানী গাঁও ও আটিপাড়া গ্রামের ধান চাষি আব্দুল হান্নান পেদা, মকবুল হোসেন, আব্দুল জলিল মোল্য, আব্দুল লতিফ বেপারী, নড়িয়া উপজেলার দুলুখন্ড, পাচক ও চান্দনী গ্রামের কৃষক নূর মোহাম্মদ শেখ, গিয়াস উদ্দিন হাওলাদার, হানিফা জমাদ্দার এবং ভেদরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ছয়গাঁও, সিঙ্গাচুড়া ও লাকাত্রা গ্রামের জান শরীফ সরদার, অলি উল্লাহ আকন ও সামাদ গাজী বলেন, আবাদের সময় অনেক বেশী খরচ হলেও গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার আমরা ধানের বাম্পার ফলন পেয়েছি। কিন্তু বাজারে ধানের দাম নেই। মাত্র সাড়ে ৪ শত টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে প্রতিমন ধান। শুনেছি এই সময় সরকার ৮ শত ৮০ টাকা দরে প্রতিমন ধান ক্রয় করবে। মৌসুমের ২ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো খাদ্য বিভাগ ধান ক্রয় শুরু করেনি। সঠিক সময়ে কৃষকের থেকে ধান না কিনে ব্যবসায়ীদের থেকে ঘুষ খেয়ে সরকার ধান কিনবে বলে শুনা যাচ্ছে।

আঙ্গারিয়া বাজারে অবস্থিত হাবিব রাইস মিল ও ভাই ভাই রাইস মিলের বর্তমান মালিক হাবিবুর রহমান ও আব্দুল হামিদ সরদার বলেন, আমরা বাজার কমিটির সভাপতি ও তার ভাইর কাছ থেকে মিল দুটি কয়েকমাস আগে ভাড়া নিয়েছি। আমরা এখানে ধান ভাঙ্গার কাজ করি ঠিকই, কিন্তু খাদ্য গুদামের সাথে আমাদের কোন চুক্তি হয়নি এবং আমরা এই মিল থেকে কোন চাউলও সরবরাহ করিনি।

শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কবীর হোসেন বলেন, সরকার কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয়ের জন্য দেড় মাস আগে থেকেই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এখনো শরীয়তপুরে ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। এটা হতাশাজনক।

নিজ দপ্তরের এত অনিয়ম আর দুর্নীতি বিষয়ে জানতে চাইলে শরীয়তপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. সামসুজ্জামান খান বলেন, ধান ক্রয়ের জন্য প্রতিটি খাদ্য গুদামকে অনেক আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা হয়তো কিছু দিনের মধ্যে ধান ক্রয় শুরু করবে। অপর দিকে রাজশাহী থেকে সিদ্ধ চাউল কিনে গুদামজাত করার ব্যাপরে তার কাছে কোন তথ্য নেই বলেও জানালেন তিনি।
(কেএইআই/পিবি/জুন ১৬,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test