E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দুর্গম এলাকার একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়টি নদী গর্ভে

২০১৬ সেপ্টেম্বর ২১ ২২:৩০:৪১
দুর্গম এলাকার একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়টি নদী গর্ভে

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : মাত্র  ৭ দিন থেমে থাকার পর ফের শুরু হয়েছে জাজিরার কুন্ডেরচরে পদ্মা নদীর রাক্ষুসী তান্ডব। দেড় হাজারেও বেশী মানুষের বসত ভিটা গ্রাস করার পর সর্বনাশা পদ্মা এবার কেড়ে নিলো দূর্গম এই চরাঞ্চলের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পাকা ভবনটি। ফলে জেএসসি, এসএসসি ও বার্ষিক পরীক্ষা সামনে রেখে মহা বিপাকে পরেছে শত শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিবাবকরা। অবশ্য প্রশাসন বলেছে বিকল্প ব্যবস্থায় চালিয়ে নেয়া হবে যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম।

মঙ্গলবার সকাল থেকে সুর্যাস্তের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত শত শত ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকার অন্যান্য শিশুদের কলকাকলীতে মুখররিত ছিল কুন্ডেরচর আলহাজ্ব ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনটি। বুধবার সুর্য উদয়ের আগেই ম্লান হয়ে গেছে সেই সব আনন্দ উল্লাস। গভীর রাতে রাক্ষুসী পদ্মার ভয়াল থাবায় বিদ্যালয়ের নব মির্মিত পাকা একাডেমিক ভবনটি ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে তলিয়ে যায় ভয়াল পদ্মার প্রবল ¯্রােতে ঘোলা জলের অতল তলে। বুধবার পুবাকাশে সুর্য উকি মারার সাথে সাথে শত শত শিশুর করুন কান্নায় ভারী হয়ে উঠে কুন্ডেরচর পদ্মা পাড়ের বাতাস। ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর প্রিয় বিদ্যাপিঠের একমাত্র সুন্দর নতুন ইমারত খানি প্রকৃতির খাম খেয়ালীতে মাত্র ছয় মাস পরেই এভাবে হারিয়ে যাবে এটা যেন তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।

সরেজমিন পরিদর্শন করে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই মাসের ২৫ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন। ইতিমধ্যে কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ৬,৭,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের হাজী মকবুল খালাসীর কান্দি, হাজী মোহাম্মদ খালাসীর কান্দি, চোকদার কান্দি, মোমিন খালাসীর কান্দি, আহমদ মোল্যার কান্দি এই ৫টি গ্রাম সম্পুর্নভাবে বিলীন হয়েছে। এ ছারাও, ইয়াকুব মাদবর কান্দি, ইউছুব বেপারীর কান্দি ও রিয়াজ উদ্দিন মাদবরের কান্দি গ্রামের আংশিক বিলীন হয়েছে। এর পার্শবর্তী নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের গফুর বেপারীর কান্দি গ্রামের একটি বিশাল অংশ ইতিমধ্যে ভাঙ্গনের কবলে পরে বেশ কিছু বসত বাড়ি ও স্থাপনা নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে।

নদী পাড়ের মানুষ জানিয়েছে, গত ৫০ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশী ভয়ংকর ভাঙ্গনের কবলে পরেছে তারা। প্রতি ঘন্টায় রাক্ষুসী পদ্মা গর্ভে বিলীন হচ্ছে শত শত ঘর বাড়ি, গাছ পালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। জুলাই মাসের ২৫ তারিখের পর থেকে অন্তত ১ হাজার ৪ শতটি পরিবার তাদের স্থাবর অস্থাবর সব কিছু পদ্মা বক্ষে হারিয়েছেন। বিলীন হয়েছে ৯টি গ্রমের ৫ টি পাকা জামে মসজিদ, দুইটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি বড় বাজার, কয়েক কিলোমিটার পাকা সড়ক, বিদ্যুতের লাইন, শত শত একর ফসলী জমি। তারা জানিয়েছেন গত দুই মাসে থেমে থেমে এই ভাঙ্গনযজ্ঞ চলে আসছিল। সাত দিন বিরতি দেয়ার পর মঙ্গলবার গভীর রাতে বিলীন হয়েছে কুন্ডেরচর ইসমাইল মেমোরিয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন ভবনটি। যে ভবনটি মাত্র ৬ মাস আগে ৬১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মান করা হয়েছিল। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই না, নতুন করে আবার ভাঙ্গন ঝুঁকিতে পরেছে রিয়াজ উদ্দিন মাদবর কান্দি গ্রাম ও কয়েকটি পাকা স্থাপনা।

স্কুল ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে পরীক্ষা সহ সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে চরম শংকায় পরেছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। তারা বিকল্প ব্যবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম ও পরীক্ষা চালিয়ে নিতে দাবী জানিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে।

কুন্ডেরচর আলহাজ্ব ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার, রুবিনা আক্তার, পনির কুমার বাড়ৈ ও কাওসার হোসাইন বলেন, আমরা মঙ্গলবারও ক্লাস করেছি নতুন ভবনে। সারা দিন কাটিয়েছি স্কুল চত্বরে। আমাদের স্কুলটি এভাবে ভেঙ্গে যাওয়ায় আমরা অনেক বিপাকে পরেছি। আজ থেকে আমাদের মডেল টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কদিন পরে জেএসসি পরীক্ষা শুরু, এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষাও হবে একই সময়ে। এর পর বার্ষিক পরীক্ষা। সামনে অনেক গুরুত্বপূর্ন ক্লাস। স্কুলের ভবন না থাকলে আমরা ক্লাস করবো কি ভাবে আর ক্লাস করতে না পারলে পরীক্ষাই দিব কি ভাবে ? আমরা জরুরী ভিত্তিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।

নদী ভাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত সমিরুদ্দিন মাদবর, ফিরোজা বেগম ও মতিউর রহমান খলিফা বলেন, সর্বনাশা ড়দ্মা নদী নদী আমাদের বসত বাড়ি, জমি জমা সবইতো নিয়ে গেছে। এর আগে দুইটি প্রাইমারী স্কুল বিলীন হয়েছে। এখন এলাকার একমাত্র হাই স্কুলটিও চলে গেল। দুই বেলা খাই না খাই, বাচ্চাদের পড়া লেখা যে করাবো সেই নিশ্চয়তা টুকুও আমরা হারিয়ে ফেললাম। সরকার যেন অতি শীঘ্র স্কুল নির্মানের ব্যবস্থা করেন, এটাই আমাদের একমাত্র দাবি।

কলমিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহানারা বেগম বলেন, গত ২৭ আগষ্ট আমাদের স্কুলটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত আবুল হাশেম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচ তলায় তিন শতাধিক শিশু শিক্ষার্থীকে নিয়ে পাঠ কার্যক্রম কোর রকমে চালিয়ে আসছিলাম। এখন সেই স্কুলটিও ভাঙ্গনের ঝুকিতে রয়েছে। স্কুল থেকে নদীর দুরত্ব মাত্র ২০ ফিট। যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। এই স্কুলটি বিলীন হলে দুইটি বিদ্যালয়ের এতগুলো শিক্ষার্থী নিয়ে আমরা কোথায় গিয়ে দাড়াবো ভেবে পাচ্ছিনা।

কুন্ডেরচর আলহাজ্ব ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার দত্ত বলেন, গত ১৭ ফেব্রুয়ারী আমাদের স্কুলের নতুন ভবনটি হস্তান্তর করা হয়। ৬১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মান করা হয়েছিল। মাত্র ৫ মাস এই ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করতে পেরেছি। মঙ্গলবার গভীর রাতে নতুন এই পাকা ভবন পদ্মা নদীতে বিলীন হয়। এখন প্রায় ৫ শত শিক্ষার্থী নিয়ে আমরা চরম বিপাকে পরেছি। এলাকায় সাহার্য করার মতও কেউ নেই। কারন যারা সাহায্য করবে তাদেরও সব কিছু শেষ হয়ে গেছে নদী ভাঙ্গায়। এখন জরুরী ভিত্তিতে নতুন স্থান নির্ধারণ করে স্কুল নির্মানের জন্য সরকারে কাছে আকুল মিনতি জানাচ্ছি।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম যাতে কোন রকমের ব্যহত না হয় সে জন্য, পার্শ্ববর্তী স্কুল গুলোতে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুইটি প্রাথমিক ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীতে শিফটিং পদ্ধতিতে হলেও শিক্ষা কার্যক্রম ও পরীক্ষা চালিয়ে নিতে ইউএনও এবং শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা সচেষ্ট রয়েছি যাতে একজন শিক্ষার্থীরও শিক্ষা জীবন সমস্যার কবলে না পরে।

(কেএনআই/এএস/সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test