E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শরীয়তপুরে বন্ধ হয়নি ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রয়ে দুর্নীতি

২০১৬ অক্টোবর ১৩ ১৭:২৯:১৯
শরীয়তপুরে বন্ধ হয়নি ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রয়ে দুর্নীতি

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : প্রশাসনের ব্যর্থতায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শরীয়তপুরে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরনে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিলাররা। সীমাহীন দুর্নীতি আর অনিয়ম করেই চলেছে ডিলাররা। কর্মসূচির দ্বিতীয় মাসের শুরুতেও ফুটে উঠেছে ভয়ংকর অনিয়মের চিত্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  ৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে কোন দুর্নীতি ছাড় না দেয়ার অঙ্গীকার করলেও তাতে কোন কর্ণপাত করছেননা কোন ডিলাররা। দলীয় লোকদের ডিলার নিয়োগ দেয়ায় অনিয়ম রোধ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তা।

ইউনিয়ন পর্যায়ে হতদরিদ্রদের জন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে। প্রকল্পের দ্বিতীয় মাস অর্থাৎ অক্টোবর মাসের বিক্রি শুরু হয়েছে গত ৭ অক্টোবর শুক্রবার থেকে । এদিন জেলার সদর, ডামুড্যা ও গোসাইরহাট উপজেলার কয়েকটি বিক্রয় কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ডিলাররা চাল মাপে কম দিচ্ছে, কোন কোন ডিলার খাদ্য গুদাম থেকে চাল উত্তোলন করেও বিক্রিয় কেন্দ্র বন্ধ রেখেছে। সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের সুবচনি বাজারের ডিলার শহিদুল শিকদারের বিক্রয় কেন্দ্রে দেখা গেছে তিনি প্রত্যেক ভোক্তা কে ৩০ কেজি চালের পরিবর্তে ২৭-২৮ কেজি করে চাল মেপে দিচ্ছেন। এর আগের মাসে তিনি ৬ শত ৭৮ জন ভোক্তার প্রত্যেককে ১৫ কেজি করে চাল দিয়ে কার্ডে এন্ট্রি করেছেন ৩০ কেজি করে। এতে তিনি ২০ হাজার ৩ শত ৫০ কেজি চাল থেকে অন্তত ১০ হাজার কেজি বা ১০ মেট্রিক টন চাল কালো বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন।

৭ অক্টোবর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার ইদিলপুর ইউনিয়নের জুসিরগাও বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ইদিলপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ডিলার জাকির হোসেন হাওলাদার তার বিক্রয় কেন্দ্রে তালা লাগিয়ে বন্ধ রেখেছেন। সেখানে অসংখ্য দরিদ্র মানুষ চাল নিতে এসে ফেরৎ যাচ্ছেন। মুঠো ফোনে জাকির হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, তদারকি কর্মকর্তা সময় দিতে না পারায় আমি দোকান বন্ধ রেখেছি।

দেখা গেছে শুক্রবার ইদিলপুর ইউনিয়নের মাছুয়াখালি নতুন বাজারের আরেক ডিলার রুবেল মিয়াও তার দোকান বন্ধ রেখেছেন। সংবাদ কর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি দুপুর ১২ টার সময় দোকান খুলে চাল বিতরণ শুরু করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদারককারি কর্মকর্তা উপজেলা সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রিপন মিয়া চাল বিক্রি করতে না বলায় আমি দোকান বন্ধ রেখেছিলাম। গোসাইরহাট খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, শুক্রবার মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে চাল বিতরণ করার জন্য ৬ অক্টোবর জাকির হোসেন ও রুবেল মিয়া উভয়ে ১০ হাজার ৭ শত ১০ কেজি করে মোট ২১ টন ৪২০ কেজি চাল গুদাম থেকে উত্তোলন করেছেন।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে অনিয়মের এক বিভৎস্য চিত্র। এ ইউনিয়নে ৮ শত ৭২ জন লোকের নামে হত দরিদ্রের তালিকা প্রনয়ন করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩ শতাধিক লোকই হচ্ছে স্বচ্ছল, আর্থিক অবস্থা সম্পন্ন, বাড়িতে পাকা বহুতল ঘর, বিত্তবান লোক। এখানে একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তির নামে কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। সংরক্ষিত ওয়ার্ডের একজন মহিলা মেম্বার তার স্বামী ও পূত্র বধুর নামে এবং বাড়ির অন্যান্য সদস্য ও বিত্তবান আত্মীয়দের নামে কার্ড বানিয়ে সেই চাল নিজে বিক্রি করে খাচ্ছেন ডিলারের সাথে আতাত করে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ডোমসার ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের কোয়াপুর গ্রামের ইউপিওয়ার্ড মেম্বার রেনু বেগম তার স্বামী আবব্দুর রহমান মাদবর, কার্ড নং ৩০২ এবং রেনু বেগমের প্রবাসী পূত্র আব্দুর রহিমের স্ত্রী রিভা আক্তার, কার্ড নং ২৯৬ এর নামে একই ঘরে দুইটি কার্ড করে দিয়েছেন। একই বাড়ির পাকা ঘরের মালিক ৩১৮ নং কার্ডধারি মমতাজ বেগমের নামেও একটি হতদরিদ্র কার্ড করে দিয়েছেন মেম্বার রেনু বেগম।

রেনু বেগম তার অপর আত্মীয় সুরম্য ইমারত ও অঢেল সম্পদের মালিক আব্দুর রাজ্জাক মাদবরের নামেও একটি কার্ড ইস্যু করেছেন। কার্ড নং ৩৩১। ২৯৮ নং কার্ডের মালিক শাহিদা বেগমের তিন ছেলে বিদেশে থাকেন। তার স্বামী বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। অথচ এই পরিবারটিও দরিদ্র কোটায় সুবিধা নিচ্ছেন মেম্বার রেনু বেগমের কল্যানে। ৩৩১ নং কার্ড হোল্ডার রাজ্জাক মাদবরের স্ত্রী তাসলিমা বলেন, আমরা বাড়িতে হাঁস মোড়গকে খাওয়ানের জন্য চাল কিনতে গেলে মেম্বার রেনু বেগম আমাদের একটি হতদরিদ্র কার্ড করে দিয়েছে। এই চাউল আমরা খাইনা, হাঁস মুরগীরে খাওয়াই। আমরা যখন জানতে পেরেছি এই কার্ড গরীবের জন্য দেয়া হয়েছে, তারপর কার্ড মেম্বারের কাছে ফেরৎ দিয়েছি।

ডোমসার ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রুস্তম মাদবরও পিছিয়ে নেই রেনু বেগমের থেকে। তিনিও তার বাড়ির একাধিক ব্যক্তি ও স্বচ্ছল আত্মীয় স্বজনের নামে অনেকগুলো কার্ড করিয়েছেন। রুস্তম মাদবর তার ভাই মতি মাদবরের স্ত্রী শাহিদা বেগমের নামে একটি কার্ড করিয়েছেন। কার্ড নং ৪৮৩। এই পরিবারটি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করছেন। একই পরিবারে মৃত টিপু মাদবরের স্ত্রী মর্জিনা বেগম ও তার অবিবাহিত ছেলে ইমরান মাদবরের নামে একই ঘরে দুইটি কার্ড করে দিয়েছেন। কার্ড নং ৪৭৭ ও ৪৮১। মেম্বার রুস্তম মাদবর ভর্তাইসার তার নিজ গ্রামে একই ঘরে মোখলেছ মোল্যা ও তার স্ত্রী রোকেয়া বেগমের নামে ২টি কার্ড করে দিয়েছেন। কার্ড নং- ৪৮০ ও ৫২৭। একই ভাবে একই গ্রামে আরেক রোকেয়া বেগম ও তার অবিবাহিতা মেয়ে মনিরা খাতুনের নামে একই ঘরে ২ টি কার্ড দিয়েছেন। কার্ড নং ৪৮২ ও ৪৮৮। ডোমসার সুজান দোয়াল গ্রামের মৃত হাশেম লস্করের ছেলে শাজাহান লস্কর একাই তিনি ২টি কার্ডের মালিক হয়ে গেছেন। তার কার্ড দুটি হলো ৭১৯ ও ৭৬৮ নং । শুধু ডোমসার ইউনিয়নই নয়, জেলার ৬৫ ইউনিয়নেরই চিত্র প্রায় একই রকম।

প্রতিটি পরিবারকে মাসে একবার ৩০ কেজি করে মোট ১ হাজার ১ শত ৪০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করার কথা জেলার ৬৫ ইউনিয়নের ৩৮ হাজার পরিবারকে। কিন্তু কর্মসূচি শুরুর প্রথম মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসেই প্রায় সাড়ে ১১ শত মেট্রিক টন চাল থেকে অন্তত ৩ শত মেট্রিক টন চাল কালো বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে ডিলাররা। আর এ চাল গুলো প্রতিটি খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও খাদ্য বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারিদের সহায়তা নিয়ে ডিলাররা বিক্রি করেছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।

শরীয়তপুর সদর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা কাজী গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমি ৭ অক্টোবর শুক্রবার সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের সুবচনি বাজারের ডিলার শহিদুল শিকদারের বিক্রিয় কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে বেশ কিছু অনিয়ম দেখতে পাই। সেখানে ভোক্তাদের চাল মাপে কম দেয়ার বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আমরা তার ডিলারসিপ বাতিলের জন্য কমিটিকে সুপারিশ করেছি। তিনি আরো বলেন, এত বড় একটা মহৎ প্রকল্প সরকারের দলীয়করনের বাইরে রাখা উচিৎ ছিল। দলীয় লোকদের ডিলারসিপ দেয়ার কারনে তারা কোন রকম পাত্তা দিচ্ছে না।

(কেএনআই/এএস/অক্টোবর ১৩, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test