E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হাবড়া নদীর উপর কাঠের ব্রীজ তৈরি করে মালামাল বহন

কালিগঞ্জের ঘুষুড়িতে পরিবেশ ধ্বংসকারী টিআরবি ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ২৪ ১৭:১৮:০৪
কালিগঞ্জের ঘুষুড়িতে পরিবেশ ধ্বংসকারী টিআরবি ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : নীতিমালা উপেক্ষা করে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ঘুষুড়ি গ্রামে তানজিন এন্টারপ্রাইজ (টিআরবি ভাটা) নামের ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই  ওই ভাটার ইট ও মালামাল বহনের সুবিধার্থে উজিরপুর শ্মশানঘাটের পাশে হাবড়া নদীর উপরে গত ১০ ফেব্রুয়ারি আড়াআড়িভাবে কাঠের ব্রীজ বানানো হয়েছে। ফলে ওই বাঁধের স্থানে পলিমাটি জমে জোয়ারভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশাঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সরেজমিনে আজ শনিবার সকালে উজিরপুর বাজার ও ঘুষুড়ি এলাকায় যেয়ে জানা গেছে, বাধাকুল মৌজার একাংশ ও ঘুষুড়ি মৌজার কিছু অংশ জুড়ে ২০০৭ সালের দিকে হাবড়া নদীর তীরে তানজিন এন্টারপ্রাইজ বা টিআরবি ইটভাটা তৈরি করেন সাতক্ষীরা সদরের চালতেতলা এলাকার মতিয়ার রহমান। ছয় বছর পর তিনি দাদনদাতাদের টাকা ফেরৎ বা ইট দিতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যান। একপর্যায়ে পাওনাদারদের টাকা ফেরৎ দেওয়ার জন্য তৎকালিন চম্পাফুল ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ ওই ভাটা নিয়ন্ত্রণে নেন। কয়েক মাস পর নলতার রহিম বক্স পাড়ের ছেলে হুদা ওই ভাটা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। একবছর পর হুদাকে বিতাড়িত করে মালিক বনে যান নলতা শরীফের বহুল আলোচিত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাই পরিচয়দানকারি ফজলুর রহমান। তিনি ভাটায় থাকা ২০ লক্ষাধিক টাকার ইট বিক্রি করে নেন। তার সঙ্গী ছিলেন উজিরপুরের রহমান। সেখান থেকে ফজলুর রহমান ওই ভাটা পরিচালনা করলেও ক্রিকটে খেলোয়াড় মোস্তাফিজুর রহমানের ভাই জাকির হোসেন, আজগার আলী, সিরাজুল ইসলাম, ফেরদৌসসহ কয়েকজনকে ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে ওই ভাটা পরিচালনা করে আসছেন। চুক্তিপত্র থাকলেও আজো টাকা ফেরৎ পাননি থালনা গ্রামের দেবদুলাল সরকার, সাাঁইহাটির রুহুল আমিন, ঘুষুড়ির হাফিজুর রহমানসহ ৩০ জনেরও বেশি প্রত্যেকে ৫০ থেকে তিন লাখ টাকা। ভাটার মাটিবহনকারি অবৈধ ডাম্পারের ধাক্কা খেয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাধাকুল চরের ৫ বছরের শিশু আব্দুস সালাম মারা গেছেন। মারাত্মক জখম হয়ে পঙ্গুত্বের পথে তারা বাবা।

দেখা গেছে, ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাবড়া নদীর উপর উজিরপুরে নতুন ব্রীজ নির্মাণের জন্য পুরাতন ব্রীজটি ভাঙার কাজ চলছে। সাধারণ মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে পুরাতন ব্রীজের পূর্ব পাশে সাত ফুট চওড়া কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। সিডিউল অনুযায়ি ানর্মাণ করা হয়নি কাঠের ব্রীজের উত্তর পাশে চলাচলের ৪০ মিটার ইট সোলিং রাস্তা। সিডিউল অনুৃযায়ি ওই কাঠের ব্রীজটি চওড়া না হওয়ায় বিশেষ করে সোমবার ও শুক্রবার হাটের দিনে যানবাহন চলাচল থেকে ব্যবসায়িদের মালামাল আনা-নেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। ওই কাঠের ব্রীজটির ২০০ গজ পূর্বে উজিরপুর শ্মশানঘাটের পাশে হাবড়া নদীর উপর দিয়ে কাঠের ব্রীজ তৈরি করা হয়েছে। ব্রীজটির দক্ষিণ পাশে রয়েছে তানজিন এন্টারপ্রাইজ (টিআরবি) ইট ভাটা। একই ভাটায় স্টার ব্রিকস তৈরি করা হচ্ছে। ওই ভাটার ইট ও ইট প্রস্তুতের মাটি ব্রীজের উপর দিয়ে ট্রলিতে করে বহন করা হচ্ছে। ইট পোড়তে ভাটায় কখনো কয়লা (ঝিকঝাক) আবার কখনো কাঠ ও পুরাতন টায়ারের গুড়ো ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাটার চিমনি থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে আড়াইশত পরিবার বসবাস করে আসছে। চিমনি থেকে ১০ শয্যা বিশিষ্ঠ ঘুষুড়ি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দূরত্ব ১৮৮৫ ফুট, কাজী আলাউদ্দিন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব ১৫২২ ফুট, চাঁদখালি সরকারি প্রাথমিক বির্দ্যালয়ের দূরত্ব ২২২০ ফুট, ঘুষুড়ি আল হেরা জামে মসজিদের দূরত্ব ৮০০ ফুট। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দূরত্ব ১১২৫ ফুট, উজিরপুর গ্রোথ সেন্টার ৯০০ ফুট। উজিরপুর বাজার থেকে ভাটার দূরত্ব ৭০০ ফুট।

চম্পাফুল ইউপি’র ৫ নং ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুস সাত্তার মোড়ল জানান, হাবড়া নদীর কাটাখালি থেকে চালতেতলা পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার খনননের জন্য ১৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ওই নদী খননের কার্যাদেশ পান পটুয়াখালির আবুল কালাম আজাদ। তিনিসহ সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুস সাত্তার খাঁ, শেখ হাফিজুর রহমান ও রাজাপুরের আফছার আলী গাজী ওই প্রকল্পের সাব টে-ার নিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিক থেকে খনন কাজ শুরু করেন। ২০২১ সালের মার্চ মাসে খনন কাজ শেষ হলেও শেষের বিল বাবদ বকেয়া ৪৮ লাখ টাকা পাননি। অথচ দু’সপ্তাহ আগে টিআরবি ভাটার ইট ও মালামাল বহনের জন্য হাবড়া নদীর উজিরপুর শ্মশানঘাটের পাশ দিয়ে আড়াআড়িভাবে দেবদারু গাছের খুঁটি ও তক্তা দিয়ে ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে খননকৃত নদীর ওই স্থানে পলিমাটি ভরাট হয়ে জোয়ার ভাটা বন্ধ হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে নদী খনননের প্রায় ১৫ কোটি টাকা পানিতে ভেসে যাবে।

ঘুষুড়ি গ্রামের আব্দুস সামাদ, আব্দুল্লাহ, চাঁদখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র শিহাব, কাজী আলীউদ্দিন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সামছুর রহমান ও স্বাস্থ্য কর্মী সাহেব আলী জানান, লোকালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা তৈরির নিয়ম না থাকলেও তা উপেক্ষা করে নির্মাণ করা হয়েছে টিআরবি ভাটা। ভাটার ইট পোড়াতে কখনো কয়লা আবার কখনো কাঠ ও পুরাতন টায়ারের গুড়ো ব্যবহার করায় তা জনসাধারণ ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। চিমনির কালো ধোঁয়ায় বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বাড়ছে। এ ছাড়া কৃষি জমির মাটি ইটভাটায় নিয়ে আসার সময় অবৈধ ডাম্পারের ধাক্কায় মানুষ, ভেড়া ও ছাগল মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া ভাটার মালামাল বহন করতে হাবড়া নদীর উপর কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে। যাহা ওই নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হুমকি স্বরুপ। অবিলম্বে ওই ভাটা বন্ধ করার আহবান জানান তারা।

ঘুষুড়ি গ্রামের আব্দুল করিম গাজীর ছেলে মোস্তফা গাজী জানান, পরিবেশ ধ্বংসকারি ও হাবড়া নদীর উপর কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করে নদীর অস্তিত্ব বিনষ্টকারি টিআরবি ভাটা বন্ধ ও নদীর উপর কাঠের ব্রীজ তুলে দেওয়ার জন্য তিনি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছেন।

টিআরবি ভাটার ১০ শতাংশের ব্যবসায়িক অংশীদার জাকির হোসেন (ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমানের ভাই) জানান, উজিরপুর ব্রীজটি সংস্কারের কাজ চলমান থাকায় জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে হাবড়া নদীর উপর যে কাঠের ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে তা যথেষ্ট সংকীর্ণ । ফলে নতুন ব্রীজ নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভাটার মালামাল ও জনসাধারণের সুবিধার্থে ওই কাঠের ব্রীজ ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

ওই ভাটার অপর ব্যবসায়ীক অংশীদার আজগার আলী জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও পাউবো প্রকৌশলীর অনুমতি সাপেক্ষে ভাটার মালামাল বহনের সুবিধার্থে কাঠের ব্রীজ বানানো হয়েছে। তবে ভাটায় কাঠ ও পুরাতন টায়ারের গুড়ো ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, পুরাতন ফর্মা থাকায় টিআরবি ইটের পাশাপাশি স্টার ইট তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েই নলতা শরীফের ফজলুর রহমান এ ভাটা পরিচালনা করে আসছেন।

টিআরবি ভাটার স্বত্বাধিকারী ফজলুর রহমান শনিবার সকাল ১১টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি পরে কথা বলবেন। তবে বিকেল তিনটার দিকে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস দীপু শনিবার সকালে জানান, বিষয়টি তিনি দেখবেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাতক্ষীরা শাখার উপপরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, আগামীকাল রবিবার ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়ে বিস্তারিত জানার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সালাহ্উদ্দিন জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তাই নদীর উপর এ ধরণের কাঠের ব্রীজ বানানোর জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খোঁজ নিয়ে ঘটনার সত্যতা পেলে প্রশাসনকে দিয়ে নদীর জন্য হুমকি স্বরুপ ব্রীজ অপসারণ করা হবে।

(আরকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test