E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরায় স্ত্রীর শরীরে ফুটন্ত জল ঢেলে হত্যার চেষ্টা

২০১৬ নভেম্বর ১০ ২০:১২:২৬
সাতক্ষীরায় স্ত্রীর শরীরে ফুটন্ত জল ঢেলে হত্যার চেষ্টা

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ‘পরকীয়া প্রেম ও যৌতুকের কারণে স্বামী জয়দেব দাস আমাকে শারীরিক নির্যাতন চালাতো। গর্ভের সন্তানকে নিজের বলে অস্বীকার করতো। দ্বিতীয় গর্ভস্তসন্তানকে হত্যা করতে না চাওয়ায় পেটে লাথি মেরে হত্যা করেছে। গর্ভের মৃত ভ্রুণ অপসারণের পর বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেতে হয়েছে দীর্ঘদিন।


এরপরও একমাত্র সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে হাতে পায়ে ধরেও স্বামীর ঘর করতে চেয়েছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। স্বামী ও ভাসুর মিলে ফুটন্ত জল ঢেলে আমাকে মারতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় বিনা চিকিৎসায় ঘরের মধ্যে পাঁচ দিন আটক রাখার পর বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার নাম করে জনৈক সাধন দাসের মহেন্দ্র গাড়িতে করে যশোরের কেশবপুরের একটি স্থানে বাচ্চাসহ ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে কলারোয়া উপজেলার সরকাটি ক্যাম্পের মাধ্যমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। এখানে কোন রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই। সুদুর কক্সবাজার থেকে এসে মামলা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই মামলা করতে রাজি হয়নি।’

বৃহষ্পতিবার বিকেলে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সার্জিকাল ওয়াডেÍ ৫ নং শয্যায় বসে এভাবেই স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের নির্যাতনের কাহিনী এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বৈদ্যপুর গ্রামের জয়দেব দাসের স্ত্রী স্মৃতি দাস (২৩)।

স্মৃতি দাস আরো জানান, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার মাদারতুলি গ্রামের মদন মোহন কর্মকারের মেয়ে সে। ১০ বছর আগে বাবা মারা যায়। দু’ ভাই ও এক বোনকে নিয়ে মা অনুকা কর্মকারের সংসার। পাড়ার পাড়ায় শাড়ি বিক্রি করে মা সংসার চালাতো। ছয় বছর আগে ভাই বাপ্পি গ্রামে একটি সেলুন বানায়। সেখানে কর্মচারি হিসেবে কাজ শুরু করে কলারোয়া উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের বৈদ্যপুর গ্রামের মনীন্দ্রনাথ দাসের ছেলে জয়দেব দাস। এর এক বছর পর পারিবারিকভাবে দেখাশুনা করেই ২০১২ সালের ৮ আগষ্ট বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের সময় নগদ ৭০ হাজার টাকা, দেড় ভরি ওজনের সোনার গহনাসহ আসবাবপত্র দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামে সেলুনে কাজ করার সময় নাহিদা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরকীয়ার জের ধরে বিয়ের একমাস পর থেকে তার উপর নির্যাতন শুরু হয়। একপর্যায়ে তিনমাস অন্তঃস্বত্বা অবস্থায় নিজে চট্টগ্রামে থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে কলারোয়ার শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় জয়দেব। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে গর্ভের সন্তানের পিতা কে তা নিয়ে নানা অবৈধ প্রশ্ন তুলে নির্যাতন চালায় জয়দেব, তার বড় ভাই অধীর দাস ও মা চায়না দাস। একপর্যায়ে তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকমাস বাপের বাড়িতে অবস্থানকালে জয়দের চট্টগ্রামের একটি সেলুনে কাজ করার সুবাদে আবারো পুরানো পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। গর্ভস্ত সন্তানের কথা ভেবে চট্টগ্রামে এসে স্বামীর পায়ে জড়িয়ে ধরে সেখানে অবস্থান করে সে(স্মৃতি)। সেখানে তিনমাস অন্তস্বত্বা অবস্থায় তাকে কলারোয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর এক সপ্তাহ পর জয়দেব বাড়িতে এসে গর্ভস্ত সন্তান নষ্ট করতে বলে। রাজী না হওয়ায় পেটে লাথি মেরে হত্যা করা হয় গর্ভস্ত সন্তানকে। একপর্যায়ে বৈদ্যপুরের একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত ঘটালেও দীর্ঘদিন ধওে নামমাত্র ঔষধ খেয়ে তাকে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় দিন পার করতে হয়েছে। পরে তাকে একমাত্র মেয়ে অনুশ্রীতার সঙ্গে নিয়ে আবারো বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তার কাছে বার বার টাকা চাওয়া হতো। কোনরকমে মায়ের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে দু’ মাস আগে শ্বশুর বাড়িতে আসে সে। টাকা দেওয়ার পরও তার উপর নির্যাতন চালাতো জয়দেব ও তার বাড়ির লোকেরা। প্রতিবেশিরা যাতে জানতে না পারে সেজন্য তাকে ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বর্তমানে জয়দেব কলারোয়ার পরিবহন কাউন্টারের পাশে উত্তম দাসের সেলুনে কাজ করে।

গত ২৮ অক্টোবর সকাল ১০ টার দিকে সে প্রতিবেশি মুজিবরের দোকান থেকে একটি শ্যাম্পুর পাতা কিনে আনায় ক্ষুব্ধ হয়ে তার(স্মৃতি) উপর নির্যাতন চালায় জয়দেব। একপর্যায়ে ভাসুর অধীর দাসের প্ররোচণায় স্বামী জয়দেব উনুনের উপর রাখা কড়াইয়ের ফুটন্ত জল তার শরীরে ঢেলে দেয়। ফুটন্ত জলে তার শরীরের বাম পাশের অংশ ঝলসে গেলেও তাকে ঘরের মধ্যে পাঁচদিন বিান চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়। থবর পেয়ে মা ও মামা এসে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

২ অক্টোবর বুধবার দুপুর ১২টার দিকে তাকে (স্মৃতি) চিরতওে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জয়দেব ও তার পরিবারের সদস্যরা। কলারোয়া দিয়ে যেতে চাইলে তাকেসহ মা, মেয়ে ও মামাকে কৌশলে সাধন দাস নামের এক মহেন্দ্র চালকের গাড়ি ঠিক করে যশোরের বেশবপুরের একটি নির্জন জায়গায় নামিয়ে রেথে আসা হয়। সেখান একে একটি ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে করে তারা কলারোয়া উপজেলার সরসকাটি পুলিশ ফাঁড়িতে চলে আসেন।

ক্যাম্প ইনচার্জ উপপরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম ঘটনা শুনে জয়দেব দাসকে তার বাড়ি থেকে আটক করে। রাত ১১টার দিকে তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশের সহায়তায় সে (স্মৃতি) বাদি গয়ে স্বামী ও ভাসুরের নামে মামলা দায়ের করে।

স্মৃতি অভিযোগ করে বলেন, বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলে গত শনিবার থেকে ভাসুর ও শ্বাশুড়ি মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে আবদার করছে। তবে সে সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে সে।

স্মৃতির মা অনিকা কর্মকার জানান, গরম পানিতে মেয়েকে ঝলসে দেওয়ার কথা তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে তিনি ধার দেনা করে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সাতক্ষীরায় আসেন। বর্তমানে হাসপাতালে থাকার সূযোগ থাকলেও নিজের খাবার কেনার টাকা নেই। জানেন না এমতাবস্থায় মেয়েকে নিয়ে কিভাবে তিনি কক্সবাজার ফিরবেন।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সার্জিকাল কনসালচ্যান্ট ডাঃ শরিফুল ইসলাম জানান, গরম পানিতে ঝলসে যাওয়া স্মৃতি দাসের শারীরিক অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে।

কলারোয়ার সরসকাটি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় স্মৃতি দাস বাদি হয়ে গত ২ অক্টোবর স্বামী ও ভাসুরের নামে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। স্বামী জয়দেব দাসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অধীর দাস পলাতক রয়েছে।
(আরএনকে/এস/নভেম্বর ১০, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test