E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রস্তুত আশ্রয়কেন্দ্র

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস : আতংকে দিন পার করছেন সাতক্ষীরার উপকূলবাসী

২০২১ মে ২৪ ১৫:২৩:০৬
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস : আতংকে দিন পার করছেন সাতক্ষীরার উপকূলবাসী

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : আম্পানে ক্ষত দাগ এখনও শুকায়নি। এখনও গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে সাতক্ষীরার উপকুলবাসী। এরইমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর সম্ভব্য আঘাত হানার খবরে গোটা উপকূলজুড়ে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র এক বছর আগে ঘটে যাওয়া ‘আম্পানের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারও একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় স্থানীয়দের মধ্যে রীতিমত ভীতিকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে টেকসইভাবে সংস্কারের অভাবে জীর্ণশীর্ণ উপকূল রক্ষা বাঁধের করুন অবস্থা উপকূলবাসীকে সবচেয়ে বেশী ভাবাচ্ছে। এছাড়া সুপেয় পানীর তীব্র সংকটের পাশাপাশি ‘আম্পান’ এর আঘাতে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি এখনও পরিপূর্ণভাবে মেরামত করতে না পারায় চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে তারা। গত দুই দিনে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুরসহ কৈখালী এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এ তথ্য মিলেছে।

স্থানীয়রা জানায়, ‘বুলবুল’ ও ‘আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া উপকূল রক্ষা বাঁধের বেশিরভাগ অংশ মজবুতভাবে বাঁধ মেরামত করা হয়নি। অনেকাংশের বাঁধ যেমন টেকসইভাবে মেরামত করা হয়নি, আবার গোটা উপকূল রক্ষা বাঁধের উপরিভাগে আজ পর্যন্ত কোন মাটির কাজ হয়নি। এমতাবস্থায় ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ যদি আবারও সুন্দরবন সংলগ্ন এ উপকূলীয় জনপদে আঘাত হানে তবে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শংকা জেগেছে। এছাড়া ভরা পূর্ণিমার কারণে একই সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় নদ-নদীতে জোয়ারের পানি ৩-৪ ফুট বৃদ্ধির প্রবল সম্ভাবনা থাকায় তারা চরম আতংকের মধ্যে দিন পার করছে বলেও জানান।

গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের ফিরোজ হোসেন বলেন, আম্পানের পর একটা বছর কেটে গেলেও গাবুরাকে ঘিরে থাকা বাঁধের উপর মাটি দিয়ে উঁচু করার ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ভাঙনমুখে থাকা অনেক জায়গার বাঁধ এখনও সরু আইলে পরিণত হয়েই আছে। এমন অবস্থায় পূর্ণিমার ভরা গোণে যদি ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ আছড়ে পড়ে তবে আমাগো সাগরে ভেসে যাতি হবে।

সবার যা হবে, আমারগোও তা মেনে নিতি হবে’- উল্লেখ করে চকবারা গ্রামের মুর্শিদা খাতুন বলেন, মাত্র দশ দিন আগে স্বামীকে বাঘে খেয়েছে। ছেলে মেয়েগো মুখে খাবার দিতি পারতিছি নে। এই দুঃসময়ে কোন জাগায় গে আশ্রয় নেবো ভেবে পাচ্ছিনে। ঝড়ের আগেই প্রতিবেশীদের সাথে মিলে চার সন্তান ও বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাবেন বলেও জানান সদ্য বিধবা এ নারী। তবে এমন শংকায় ভরা অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি কেবল ফিরোজ হোসেন বা মুর্শিদার কণ্ঠেই না। বরং গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালীনি আর কৈখালীসহ উপকূলীয় জনপদে বসবাসরত হাজারও মানুষের মধ্যে কাজ করছে অভিন্ন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

স্থানীয়রা জানায়, ভাগুর বাঁধের দুরাবস্থা আর কর্মসংস্থানসহ পানীয় জলের তীব্র অভাবে প্রতিনিয়ত তারা জীবনের সাথে সংগ্রাম করে চলেছেন। প্রকৃতির হুমকিতে বার বার বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া ও ফিরে আসার এমন টানা হেঁচড়ার মধ্যে ভাঙন কবলিত বাঁধ তাদের দুর্দশায় অন্যতম প্রধান কারণ। আশ্রয় কেন্দ্রে যেয়ে নিজেদের জীবন বাঁচানোর সুযোগ থাকলেও বাড়ি ঘর আর গৃহস্থলীর জিনিপত্রের সাথে সাথে পোষ্য গবাদী পশু-পাখি নিয়েও তারা চিন্তিত রয়েছেন।

সুন্দরবনের সবচেয়ে নিকটস্থ জনবসতি গোলাখালীর আকিরুন বেগম বলেন, তিন পাশে নদী আর এক পাশে বনকে আশ্রয় করে আমাগো বাস। আম্পানের আঘাতে বাঁধ ভেঙে সমগ্র এলাকা এলো হয়ে গেলো।

তিন/চার দিন আগে স্থানীয়রা বাঁধের ভাঙন কবলিত অংশ বেঁধেছে’- উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবারের ঘূর্ণিঝড় ভরা জোয়ারের সময় আঘাত করলে সাগরের সাথে মিশে যাতি হবে’। শেষ মুুহূর্ত পর্যন্ত দেখে বাড়িঘর ফেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাবেন বলেও জানান এ নারী।

একই গ্রামের আসলাম হোসেন জানান, রোববার থেকে গোণ শুরু হয়েছে। ‘ইয়াস’ এর সাম্ভব্য আঘাতের সময় ২৬ মে হলে তখন নদীতে জোয়ারের পানি মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ঐ মুুুহূর্তে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে গোটা উপকূল সাগরের সাথে একাকার হয়ে যাবে। আগেই বাড়িঘর ছেড়ে যেয়ে নিজেদের হয়ত বাঁচানো যাবে- জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বসতবাড়িসহ এতবছর ধরে গড়ে তোলা সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার শংকার মধ্যে রয়েছেন গ্রামের প্রায় সত্তরটি পরিবার।

বুড়িগোয়ালীনির দুর্গাবাটি গ্রামের প্রভাষক পরীক্ষিত মন্ডল ও নিলুৎপল মন্ডল জানান, আম্পানের আঘাত কাটিয়ে উঠার চেষ্টার মধ্যে মাত্র দুই মাস আগে বাঁধ ভেঙে গোটা এলাকা প্লাবিত হয়। যার প্রভাবে ইতোমধ্যে গোটা এলাকাজুড়ে খাবারসহ ব্যবহার উপযোগী পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় নুতন করে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর আঘাতের পূর্ব ঘোষণাতে এলাকাবাসীর মধ্যে নিদারুন অসহায়ত্ব ভর করেছে। নদী প্রান্তের চর দেবে যাওয়াতে বাঁধের দুরাবস্থা গোটা এলাকায় আতংক ছড়াচ্ছে- জানিয়ে তারা আরও বলেন, পরিস্থিতি বুঝে স্থানীয়রা নির্ধারিত সময়ের আগেই আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার মনস্থির করেছে। তবে ছেড়ে যাওয়া বাড়িঘর ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে সকলেই দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে বলেও তারা দাবি করেন।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর আঘাতের আগাম খবরে গোটা উপকূলজুড়ে এক ভয়ার্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সবাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার বিষয়ে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে অধিক জোয়ারের চাপে বাঁধ ভেঙে বা ছাপিয়ে সাগরের পানিতে সমগ্র এলাকা প্লাবিত হওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশী শংকায় রয়েছেন বলেও জানান। কেননা প্লাবিত হলে আবারও ঘরবাড়ি পুকুর জলাকার লবণ পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ছাড়াও সমগ্র জনপদজুড়ে পানীয় জলের অভাব প্রকট হওয়া নিয়েও তারা চিন্তিত।

জাতীয় মহিলা সংস্থার শ্যামনগর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা শাহানা হামিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এলেই অনেক কথা হয়। কিন্তু তৎপরবর্তী পর্যায়ে ঝুঁকির মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষার বিষয়ে কার্যত কোন দৃঢ় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুর্যোগের সময়ে তার বার বার উদ্বাস্তু হওয়ার শংকার মধ্যে পড়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা ডিভিশন-১ এবং ২ এর (শ্যামনগর অংশ) দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের ও জানান, আম্পানের আঘাতের পর ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে যেগুলো বাকী আছে সেগুলো দ্রুত মেরামতের জন্য অব্যবহত রয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, আমরা ব্যাপকভাবে প্রস্তুত গ্রহণ করেছি। সেখানে ১৪৫ টি আশ্রয় কেন্দ্র ও আরো ১৫০০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া ১৮৩ মেঃ টন খাদ্য প্রস্তুত ও ২ কোটি নগদ টাকা আর্থিক সহযোগিতার জন্য রাখা হয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত পানি, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওয়াটার ট্যাংকিং রয়েছে, পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

(আরকে/এসপি/মে ২৪, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test