E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নড়াইলের পোষ্ট ই সেবা কার্যক্রম নিয়ে তুঘলকি কান্ড

২০১৬ ডিসেম্বর ০১ ১৭:৪৮:১৮
নড়াইলের পোষ্ট ই সেবা কার্যক্রম নিয়ে তুঘলকি কান্ড

লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি : ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকারের ‘একসেস টু ইনফরমেশন’ কর্মসূচীর আওতায় ২০১৫ সালের জানুয়ারীতে শুরু হওয়া পোষ্ট ই-সেবা কেন্দ্র কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেন্দ্র গুলোর নামে বরাদ্দকৃত সরঞ্জাম বাইরের বাজারে বিক্রি, বরাদ্দের চেয়ে কম সরঞ্জাম প্রদান, টাকা নিয়ে উদ্যোক্তাদের বাইরের অন্য প্রতিষ্ঠানে সরঞ্জাম দেয়া এবং ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে উদ্যোক্তার সেন্টারে সরঞ্জাম প্রদানের অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এর ফলে প্রায় দুই বছরে জেলায় ৭৫ ভাগ পোষ্ট ই-সেবা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। বরাদ্দের সব টাকা কর্মকর্তাদের পেটে চলে গেছে। এককথায়, পোষ্ট ই সেবা নিয়ে নড়াইলে চলছে তুঘলকি কান্ড কারখানা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হচ্ছে, এ বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরেও সংশ্লিষ্ট উদ্ধর্তন কতৃপক্ষের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গেনি।

তথ্যানুসন্ধানকালে জানা গেছে, জেলার ৮২ টি ই সেন্টারের মধ্যে ১০ থেকে ১২টি সেন্টারে সম্পূর্ন মালামাল প্রদান করা হয়েছে আর এ জন্য উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অন্ততঃ ২০ টি সেন্টারে ৩টি ল্যাপটপের স্থলে দেয়া হয়েছে ১টি করে। বাকি প্রায় ৪০টি সেন্টারে কোন মালামালই প্রদান করা হয়নি। গত ১৬ অক্টোবর দুদক আয়োজিত গনশুনানীতে কেন্দ্রের মালামাল না পাওয়া দুইজন উদ্যোক্তার অভিযোগের পরে বিষয়টি জনগনের নজরে আসে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাস থেকে সারা দেশের মতো নড়াইলে পোষ্ট ই সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় নড়াইল উপ বিভাগের অধীনে যশোরের ৮টি এবং নড়াইলের ৮২টি সহ ৯০টি শাখা পোষ্ট অফিসকে ই-পোষ্ট সেন্টারে রূপান্তর করা হয়। এর মধ্যে যশোর সদর ও বাঘারপাড়ায় ৮টি, নড়াইল সদরে ২৯টি, লোহাগড়ায় ২৮টি এবং কালিয়া উপজেলায় ২৫টি কর্মসূচীর আওতায় সংশ্লিষ্ট পোষ্টমাষ্টার নিজে উদ্যোক্তা হবেন অথবা নতুন উদ্যোক্তা নির্বাচন করবেন। ঐ উদ্যোক্তা পার্শ্ববর্তী সুবিধাজনক স্থানে একটি পোষ্ট ই সেন্টার প্রতিষ্ঠা করবেন। সেখানে সরকারী ভাবে ৩টি ল্যাপটপ,একটি প্রিন্টার,একটি স্ক্যানার কাম ফটোকপিয়ার, ইন্টারনেট সংযোগের জন্য মডেম,বিদুৎ সরবরাহের জন্য সোলার প্যানেল সহ মোট প্রায় ৩লক্ষ ৮০হাজার টাকার মালামাল বিনামূল্যে প্রদান করবে। সরকারী মালামালের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা এলাকার জনগনকে কমমূল্যে নানা ধরনের আইটি সেবা প্রদানসহ পোষ্ট অফিসের সকল সেবা প্রদান করবে। মাস শেষে সেন্টারের আয়ের ২০শতাংশ অর্থ এলাকার পোষ্টমাষ্টারকে প্রদান করবে, যার ১০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট পোষ্টমাষ্টার এবং বাকি ১০ শতাংশ সরকারি খাতে জমা হবার কথা। অথচ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকটি শাখা পোষ্ট অফিস ও ই সেবা কেন্দ্র ঘুরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে ।

নড়াইল সদরের নড়াইল-ফুলতলা সড়কের গোবরা শাখা পোষ্ট অফিসের পোষ্ট মাষ্টার অতুল কৃষ্ণ পাল জানান, প্রায় দেড় বছর আগে এখানে একটি ল্যাপটপ, একটি স্ক্যানার ও প্রিন্টার প্রদান করা হয়েছে। একজন উদ্যোক্তা ও নিয়োগ করা হয়েছিলো। কয়েক মাস কাজ করে সে চলে যায়। মালামাল গুলো অব্যবহৃত অবস্থায় তার বাড়িতে পড়ে রয়েছে।

সদরের ভদ্রবিলা বাজারের ই পোষ্ট সেন্টারের উদ্যোক্তা শরিফুল ইসলাম জানান, তিনি ভদ্রবিলা বাজারে এই পোষ্ট ই সেন্টার খোলার জন্য উদ্যোক্তা নির্বাচিত হয়ে দেড় বছর ধরে মালামাল চেয়ে ও পাচ্ছেন না,ফলে তিনি সেন্টার তৈরী করতে পারেননি। মালামাল চাইলে নানা অজুহাত দেখান পোষ্ট অফিসের পরিদর্শক বরুন কুমার দত্ত। ২০১৬ সালের জানুযারী মাসে তিনি বলেন আপনার মাল ভুলে অন্য এলাকায় চলে গেছে,এর একমাস পরে আবার বলেন তার সহ আরও কয়েকজনের সরঞ্জাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফেরত চলে গেছে।শরিফুল ইসলামের ধারনা তাদের বরাদ্দকৃত মালামাল উনারা(পোষ্ট অফিসের লোকেরা) বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন।

নড়াইলের হাটবাড়িয়া শাখা পোষ্ট অফিসের পোষ্টমাষ্টার আঃ আলীম মোল্যা জানান, তার পোষ্ট অফিসের অধীনে একটি পোষ্ট ই সেন্টার খোলার কথা তিনি শুনেছেন দেড় বছর আগে, কিন্তু কোন সরঞ্জাম এখনো আসেনি।এ ব্যাপারে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে কোন ভালো উত্তর পাইনি। হয়ত আমার সেন্টারের মালামাল অন্য কোথাও প্রদান করা হতে পারে।

কালিয়ার জামরিলডাঙ্গা বাজারের উদ্যোক্তা তোয়াক্কেল গাজী জানান,এসব ব্যাপারে দেড় বছর আগে প্রশিক্ষন নিয়ে এসছি। নড়াইল বাদে বাইরের সব জেলার পোষ্ট ই সেবার মালামাল সব সেন্টারে চলে গেছে আরো এক বছর আগে,কিন্ত আমার সেন্টারের মালামাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিদর্শক বরুন কুমার দত্ত। পরে খোজ নিয়ে জানতে পারি আমার এলাকার সকল মালামাল পেড়লী বাজারে নিঝুম কোচিং এন্ড আইটি সেনটার নামের একটি প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়েছে।

কালিয়ার পেড়লী বাজারে খোজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে পোষ্ট অফিসের অধীনে একটি ই-সেন্টার রয়েছে যেটি পরিচালনা করেন আল-আমীন নামের একজন উদ্যোক্তা। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে নিঝুম কোচিং এন্ড আইটি সেনটার নামের কোচিং সেন্টারে পোষ্ট ই সেন্টারের মালামাল প্রদান করা হয়েছে। ঐ কোচিং সেন্টারের মালিক জাহেদ হাসান জানান, রাজ্জাক নামের একজন ট্রেইনার কে টাকার বিনিময়ে মালামাল গুলো তিনি পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ম বহিভর্র্’ত হয়েছে কিনা এটা জানতে চাইলে তিনি সরকারী খাতে টাকা জমা দেবার কথা বলেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে অস্বীকার করেন।

লোহাগড়া উপজেলার মরিচপাশা শাখা পোষ্ট অফিসের পোষ্টমাষ্টার মনিরুল ইসলাম জানান,আমারে মালামাল পরে দিতে না চাইলে আমি বললাম, দাদা (বরুন) আমারে একটা ল্যাপটপ দেন, এরপর একটা ল্যাপটপ পাইছি। এখন ও ই পোষ্ট সেন্টার তৈরী করা সম্ভব হয়নি। আমি পোষ্টমাষ্টার বলে আমার মালামাল নিয়ে কোন গাফিলতি করেননি। তবে ল্যাপটব একটা পেলাম কেন তা জানতে চেয়ে ও আমি ভালো কোন জবাব পাইনি।
কালিয়ার একটি ইউনয়নের পোষ্ট ই সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা তসলিম ইসলাম জানান,তার কাছ থেকে ই সেন্টারের মালামাল দেবার জন্য প্রায় ৬ মাস আগে ১২হাজার টাকা নিয়েছে পরিদর্শক বরুন বাবু,অথচ এখন আমাকে উদ্যোক্তা বানাতে চাচ্ছে না।খবর পেয়েছি আরেকজনের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে তাকে মালামালগুলো দেয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাইজপাড়া,হবখালী,কলোড়া ইউনিয়নের কয়েকজন শাখা পোষ্টমাষ্টার এবং উদ্যোক্তা জানান, প্রত্যেক সেন্টারের মালামালের জন্য ৩০ হাজার টাকা প্রদান করেছেন। ২জন বলেন,তাদের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে নিয়ে মালামাল দিয়েছেন বরুন বাবু ও তার সহযোগী ট্রেইনার রাজ্জাক।

সদরের ধুড়িয়া গ্রামের শিবু পদ বিশ্বাস বলেন,আমাদের বাগশ্রিরামপুর পোষ্ট অফিসের আওতায় এ ধরনের কোন ই সেন্টার খোলার খবর আমরা পাইনি। মালামাল কে পেয়েছে তাও বলতে পারবো না।

সদরের চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের কুড়ালিয়া পোষ্ট অফিসের আওতায় ই সেন্টার সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন,এখানে একটি কম্পিউটার দেয়া হয়েছিলো তা পোষ্ট মাষ্টারের বাড়ি থাকে,কোথাও কোন সেন্টার বানাতে দেখিনি। এখানে কোন পোষ্ট অফিসেরই অস্থিত্ব নাই তার ই সেন্টার।

ঘটনার সত্যতা যাচাই এর জন্য একাধিকবার নড়াইল পোষ্ট অফিসের পরিদর্শক বরুন কুমার দত্ত এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে অস্বীকার করেন। এ ব্যাপারে সবকিছু যশোরের ডিপিএমজি সাহেব সবকিছু নিয়ন্ত্রন করেন বলে তিনি জানান। এরপর ডি পি এম জির (ডেপুটি পোষ্ট মাস্টার জেনারেল) মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি স্যারের সাথে কথা বলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে জেলার মোট ৮২টি শাখা পোষ্ট মাষ্টার এবং উদ্যোক্তার তালিকা চাইলে আবার যশোরে ফোন করেন। ওপাশ থেকে ডেপুটি পোষ্টমাষ্টার জেনারেল সাহেব তাকে তালিকা দিতে নিষেধ করলে তিনি জানান,এগুলো অফিসিয়াল নথি,বাইরে দেয়া যাবে না।

অভিযুক্ত নড়াইল পোষ্ট অফিসের হিসাবরক্ষক কাম পরিদর্শক বরুন কুমার দত্ত তার বিরুদ্ধে আনা মালামাল বিক্রি ও টাকার বিনিময়ে মাল প্রদানের বিষয়ে অস্বীকার করে বলেন, একজন অভিযোগ করলেই তো হল না, দুদকে সরাসরি অভিযোগ প্রদান সম্পর্কে তিনি বলেন,মালামাল বিতরন প্রক্রিয়া এখনও চলমান আছে।

নড়াইল প্রধান ডাকঘরের পোষ্টমাষ্টার মোঃ আতিকারুল ইসলাম জানান,ই পোষ্ট অফিসের মালামাল, নিয়োগ বেতন সহ সকল কার্যক্রম মূলত পোষ্ট অফিস পরিদর্শক বরুন কুমার দত্ত দেখেন। এখানে আমার কোনরকম হাত নেই। কিছু করার নেই। কাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে,কতগুলো মাল দেয়া হয়েছে,কোন টাকা পয়সা নেয়া হয়েছে কিনা তা উনি ভালো বলতে পারবেন। উনার উপরের কর্মকর্তা যশোরের ডেপুটি পোষ্টমাষ্টার জেনারেল(ডিপিজিএম) মোঃ আবু তালেব তাকে সব ধরনের পরামর্শ ও নির্দেশ প্রদান করে থাকেন।

ই পোষ্ট সেন্টারের মালামাল প্রদানে অস্বচ্ছতা বিষয়ে জানার জন্য যশোর পোষ্ট অফিসে ডিপুটি পোষ্টমাষ্টার জেনারেল মোঃ আবু তালেব এর অফিসিয়াল টেলিফোনে যোগাযোগ করলে সাংবাদিক পরিচয় পাবার পরে তিনি অফিসে নেই বলে জানানো হয়। ১ নভেম্বর নড়াইল হেড পোষ্ট অফিস পরিদর্শনে আসেন যশোরের ডেপুটি পোষ্টমাষ্টার জেনারেল মোঃ আবু তালেব । এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি কালের কন্ঠকে বলেন, এগুলো অনেক পুরানো বিষয় এ নিয়ে সাংবাদিকদের এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে। আপনার যা জানার দরকার তা নিয়ম অনুযায়ী লিখিত দেন, আমরা আপনাকে তথ্য দেব।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারন সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান জানান, নড়াইলের গনশুনানীতে দুদক কমিশনার এ,এফ,এম আমিনুল ইসলাম এর উপস্থিতিতে দুটি লিখিত অভিযোগ পাঠ করা হয়েছে,তবে পরিদর্শক উপস্থিত না থাকায় ভালো জবাব পাওয়া যায়নি। অভিযোগুলো দুদক আমলে নিয়ে তদন্ত করছে।

(আরএম/এএস/ডিসেম্বর ০১, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test