E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘ঈদ আমার জন্ন্যে নাহায় বাহে’

২০১৭ আগস্ট ৩০ ১৭:১০:৪৪
‘ঈদ আমার জন্ন্যে নাহায় বাহে’

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : দিনাজপুরে ঈদের আমেজ নেই বন্যাদুর্গত এলাকায়। দুর্গত মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এখন দিশেহারা। চারদিকে বিধবস্ত। বন্যায় হারিয়েছেম ঘর-বাড়ি, হারিয়েছে ফসল। কেউবা হারিয়েছে স্বজন। মৃত্যু হয়েছে বন্যায়। এখন এসব বানভাসি ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের হৃদয়ে ধু,ধু শ্মশান। বিশুদ্ধ পানি আর একমুঠো খাবারের কষ্টে যেনো যায় যায় তাদের প্রাণ। এ অবস্থায় ঈদুল আযহার আমেজ নেই বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের। ক্ষতিগ্রস্থ অনেক মানুয়ের এবার হচ্ছেনা কোনো পশু কোরবানি।

বিরল উপজেলার বিজোড়া ইউনিয়নের বেকাহার মোলøাপাড়া গ্রামের মানুষিক ভারসাম্যহীন আজগরের বাড়িতে দেখা গেল তার স্ত্রী ভ্যানের উপর বসে নামায আদায় করছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ঘর-বাড়ি তৈরী করতে না পারায় এভাবেই ফাকা জায়গায় রয়েছেন তারা। বন্যায় তলিয়ে গেছে তার কষ্টার্জিত ফসল।

এনজি’র কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে দেড় বিঘা জমিতে রোপা আমন লাগিয়েছিলেন আহাচান মিয়া। সবই তলিয়ে গেছে বানের পানিতে। এখন চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না তার। ৩ মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার। এদের পেট ভরে দু’বেলা খেতে দিতে পারেন না। আর কয়েকদিন পরেই ঈদ। কিন্তু ঈদের আনন্দ নাই তার পরিবারে। এ নিয়ে ভাবতেও চান না ষাটোর্ধ্ব বয়সী আহচান। তার ভাবনা পরিবারের সদস্য নিয়ে কিভাবে খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। এছাড়া আর কোনো ভাবনা আসে না তার মনে। ঈদ উপলক্ষে কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্য জোটেনি তার কপালে। ছোট ছেলে মেয়েরা ঈদের বায়না করতে চাইলে সজোরে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন ছেলে-মেয়েদের। দুশ্চিন্তায় আর নানা হতাশায় রাতে ঘুমুতে পারেন না তিনি ।

শুধু আহচান নয়, একই অবস্থায় আশপাশ গ্রামের অনেক পরিবার। এসব পরিবারে চলছে নীরব হাহাকার। ঈদ যেন কোনো জানান দিতে পারেনি তাদের মনে। সরজমিনে বিরল উপজেলার আরো কয়েকটি গ্রাাম ঘুরে চোখে পড়ে একই চিত্র। সর্বত্রই বেঁচে থাকার লড়াই করে চলেছেন বানভাসিরা। ঈদ আসছে এটুকই জানেন তারা। এর বেশি কোনো অনুভূতি নেই তাদের।

প্রতি বছর ঈদের আনন্দ তাদের ছুঁয়ে গেলেও এবার তা কেড়ে নিয়েছে বন্যায়। বন্যার পানি কমে গেলেও সংগ্রাম থামেনি তাদের। নতুন করে নিজের ঘর তৈরি করছেন অনেকে। ভিটেতে মাটি ভরাট করছেন। ঝুপড়ি বেঁধে থাকছেন। কেউ কেউ পুরনো ঘরে উঠেছেন ঠিকই। কিন্তু অনেক ঘরই নড়বড়ে, জরাজীর্ণ। ভিটে-মাটি স্যাঁতসেঁতে। খাবার নেই। সবাই বন্যার্ত। সবার একই অবস্থা। নিম্নবিত্তরা কাজের সন্ধানে নানা স্থানে ছুটলেও মধ্যবিত্তরা বেকায়দায়। অন্যান্য বারের মতো এবার কোরবানি দিতে পারছেন না তাদের অনেকেই। গ্রামের পর গ্রামে এবার কোনো কোরবানি হচ্ছে না। দিনাজপুরে জেলার প্রায় সাড়ে ৬ লাখ বানভাসি মানুষের মধ্যে বেশিরভাগের একই অবস্থা।

পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ইবরাহিমপুর গ্রামের অছিমন জানান, গরিবের আবার কিসের ঈদ ! ঈদতো হইলি বড় লোকের জন্ন্যে। হামারতো তামাম শেষ ! কি খামো, আর কি করিমমো,পাছিনা দিশকুল ! ঈদ আমার জন্ন্যে নাহায় বাহে !

ফরকাবাদ ইউনিয়নের ভবানীপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে অন্যান্য বছর প্রায় সবাই কোরবানি দিতো। সেই কোরবাণি’র মাংস দশের মাধ্যমে ভাগ বাটোয়া করে দিতো গ্রাম্য মাতববররা। এবার এই গ্রামে তেমন একটা সারা নেই কোরবানি ঈদের।

পলাশবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আজাহার আলী জানান, লোকজন খাবার পাচ্ছে না। ফসল সব বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। ঘর-দুয়ার নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ কুরবানির দিবি, নাকি ঘর দুয়ার মেরামত করিবি? একই অবস্থা এলাকার বেশিরভাগ মানুষের। গরিব-ধনী সবাইকে নিঃস্ব করে দিয়েছে বন্যা। বন্যার কারণে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এলাকার সকল শ্রেণির মানুষ।

এরকম বন্যা আগে দেখেননি এলাকার বৃদ্ধ মোজাহার আলী। অল্প সময়ে এতো পানি হয়নি কখনও। জিনিসপত্র রক্ষা করার সময় পায়নি মানুষ। চোখের পলকে সব কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেন, জীবনে এরকম বান দেখিনি বাহে। বন্যা সব কাড়ি নিছে হামার। কোরবানি দেই কি করি ?

এ গ্রামের আশপাশে ফসলি জমির শত ভাগই তলিয়ে যায় বন্যায়। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েন এলাকার অসংখ্য কৃষক। পানি নেমে গেছে। কিন্তু ৯০ ভাগই ফসল নষ্ট হয়েছে এ এলাকায়। বন্যার পানিতেই তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে তাদের জীবন। গ্রামে মুষ্টিমেয় লোকজন ত্রাণ পেলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল।

এবারের বন্যা কৃষকের সঙ্গে সঙ্গে কোমর ভেঙে দিয়েছে মৎস চাষিদের। দিনাজপুরে চার হাজার ৫১৮ দশমিক ৬ হেক্টর আয়তনের ৩৬ হাজার ৮৩টি পুকুর, দীঘি ও খামারের মাছ বন্যায় ভেসে গেছে। দিনাজপুর অঞ্চলে ৮ হাজার মৎস্য চাষী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখন সহায় সম্বলহীন। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। যদিও মৎস বিভাগ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থ চাষিদের পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে রিহ্যাবিলেট করা হবে।

বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েন ৪ লাখ ৪২ হাজার কৃষক। আমন, সবজি, বীজতলা,মরিচ, পাট ও কলাসহ নানা ধরণের সবজি ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ায় চরম সংকটে এখন তারা । ভয়াল বন্যায় এই অঞ্চলের এক লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমির আমন, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ নষ্ট হয়েছে। ফলে কৃষকদের সামনে এখন অনিশ্চিত অন্ধকার। তারা সবকিছু হারিয়ে অনেকটা পথে বসার উপক্রম। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের আর্তনাদ চলছে। তাই ঈদ হচ্ছেনা কারোই।

ক্ষতিগ্রস্থ বানভাসিদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনার কেউ নেই বলে তাদের অভিযোগ। তাদের দাবি একটাই, শুধু মুখে নয় সরকার যেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। সবার মতো তারাও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে।

(এসএএস/এসপি/আগস্ট ৩০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test