E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চট্টগ্রামে প্রতিমাসে ১৫ কোটি টাকার চোরাই কাঠ পাচার!

২০২৩ জুলাই ১৭ ১৪:৪৫:৪৯
চট্টগ্রামে প্রতিমাসে ১৫ কোটি টাকার চোরাই কাঠ পাচার!

জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম : কোন ভাবেই থামছে না চোরাই কাঠ পাচার। পার্বত্য চট্টগ্রামে বেপরোয়া কাঠ পাচারের ফলে বনজ সম্পদ উজাড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনিয়মের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে কাঠ ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীরা। চোরাই কাঠের রমরমা বাণিজ্যের কারণ অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, স্থল কিংবা জলপথ , যে পথেই পাচার হোক না কেন পথের প্রতিটি চেকপোস্টকে ম্যানেজ করা হয় অর্থের বিনিময়ে। এ অর্থ মাসিক কিংবা গাড়ি প্রতি দুই ভাবেই হতে পারে। সরকারী কিংবা বেসরকারী যে কোন স্থানের গাছ কাটতে হলে বন বিভাগ থেকে লিখিত অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক।

বন বিভাগীয় কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে গাছ কাটা যাবে কি–না এ ব্যাপারে মতামত প্রদান করেন। বনবিভাগের পরিসংখ্যান, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, বোয়ালখালী, বাঁশখালীসহ ১৪টি উপজেলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের কাউখালী, কাপ্তাই, বরকল, নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, রোয়াংছড়ি, লামা, মানিকছড়ি, দীঘিনালাসহ ২৫টি উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু ও উপকূলীয় অঞ্চলসহ সেখানকার ৫টি উপজেলায় বনবিভাগের বনভূমি রয়েছে ১৬ লাখ ৮৮ হাজার একরের মতো।

এসব জায়গায় বনবিভাগের সংরক্ষিত বন, :সৃজিত বন, অর্পিত বন ও অশ্রেণীভুক্ত বনভূমি রয়েছে। আরো রয়েছে বনবিভাগের শ’খানেক শুল্ক ফাঁড়ি। এসব বনাঞ্চল থেকে এবং বিভিন্ন সময় চোরাই কাঠ অভিযানে জব্দকৃত কাঠগুলো দরপত্রের মাধ্যমে লাইসেন্সধারী কাঠ ব্যবসায়ীদের মাঝে বনবিভাগ বিক্রয় করে । ব্যবসায়ীরা দরপত্রে অংশগ্রহণ করে বনবিভাগের ওইসব নির্ধারিত মালামাল বাবদ মূল্য পরিশোধ করে নিজ ব্যবসায়িক গন্তব্যে কাঠ সরবরাহ করে থাকেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিমাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম , উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫ লাখ ঘনফুট কাঠ চট্টগ্রাম নগরী ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পাচার হচ্ছে। যার আনুমানিক মূল্য ১৫ কোটি টাকা। জানা গেছে, অভিযানে যে পরিমাণ কাঠ আটক হয়, পাচার হয়ে যায় তার চাইতে অনেক বেশি কাঠ। সড়ক ও নৌপথে কাঠ পাচারের প্রস্তুতি থাকে পাচারকারীদের।

এছাড়া এদের হয়ে কাজ করার জন্য বিশ্বস্ত সোর্সও নিয়োগ দেয় তারা। সড়ক পথে কড়াকড়ি আরোপের খবর পেলে নৌপথে পাচার করা হয় কাঠ। এক হিসাবে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা সড়কপথে বৈধভাবে কাঠ নিয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছতে তাদেরকে গাড়ি প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। এভাবে দৈনিক আড়াই লাখ টাকার মতো চাঁদাবাজি হচ্ছে। আবার অবৈধভাবে যেসব কাঠ আসে সেগুলোর চাঁদার অংক দ্বিগুণ।

বর্তমানে সাঙ্গু ও ধোপাছড়ি বন বিটের সংরক্ষিত বাগান থেকে কাঠ পাচার প্রকাশ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন এখান থেকে লাখ লাখ টাকার সেগুনসহ মূল্যবান প্রজাতির কাঠ পাচার হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পরোক্ষ সহযোগিতায় পাচারকারীরা নির্বিঘ্নে কাঠ পাচার করে আসছে।

জানা গেছে, কাঠ পাচারকারীরা ধোপাছড়ি ও সাঙ্গু বিটের সংরক্ষিত বন বাগান থেকে কাঠ কেটে শঙ্খ নদী দিয়ে চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী ও সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া, পুরানগড়, শীলঘাটা, ধর্মপুর, কোরানীহাট ও কাটগড় লামার বাজার এলাকায় চোরাই কাঠ মজুদ করে।কাঠ চোরদের ব্যক্তিগত ডিপোর মজুদ কাঠ ট্রাকযোগে ত্রিপল মুড়িয়ে কিংবা বালি ভর্তি ট্রাকযোগে অথবা ভুষির বস্তার নিচে দিয়ে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে ঢাকার ফরাশগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, লংগদুসহ আশেপাশের এলাকার পাহাড় থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনফুট কাঠ রাঙাপানি এলাকায় জমা করা হয়। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে মূলত: ট্রাকে করে কাপ্তাই সড়ক অথবা রাঙামাটি সড়ক হয়ে পাচার করা হয় নগরীতে । এছাড়াও দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন সরকারি পাহাড় থেকে কাঠ কেটে মজুদ করা হয় কর্ণফুলি নদীর তীরবর্তী এলাকায়। এছাড়া কাপ্তাইয়ের শিলক, কোদালা, রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটাসহ বিভিন্ন এলাকার স’মিলে মজুদ করা হয় এসব কাঠ। পরে সুযোগ বুঝে নদীপথে অথবা সড়ক পথে নিয়ে আসা হয় কালুরঘাটে। আবার রাঙামাটির বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে মূলত: কাঠ পাচার করা হয় রাইখালী হয়ে রাঙ্গুনিয়া অথবা কারিগরপাড়া, বাঙ্গালহালিয়া ঘুরে রাঙ্গুনিয়ার ডাকবাংলো, দুধপুকুরিয়া, দশমাইল ও সুখ বিলাস হয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা অথবা চান্দের গাড়িতে শিলক, কোদালাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে আসা হয়।

পার্বত্যাঞ্চল থেকে চোরাই কাঠ বেশি পাচার করা হয় ট্রাকে করে। এসব কাঠ নগরীর বলীরহাট, আলকরণ, বাদুরতলা, কালুরঘাট, কর্নেলহাট এবং ঢাকার সবুজবাগ, মিরপুর, মগবাজার, তেজকুনিপাড়া, রামপুরা, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে। অভিযোগ রয়েছে পুলিশ ও বনবিভাগের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রতিদিন পাচার হচ্ছে হাজার হাজার ঘনফুট গাছ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাঠ পাচারকারী চক্রের সদস্যরা বলেন, রাঙামাটি ও কাপ্তাই হয়ে নগরীতে কাঠ পৌঁছাতে তাদের ১১ টি স্থানে টাকা দিতে হয়। একই ভাবে ঢাকায় পৌঁছাতে ২১ টি স্থানে তারা টাকা দেয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের অধিকাংশ কারণই মনুষ্য সৃষ্ট। একের পর এক বন উজার করে পাচার হচ্ছে কাঠ। চোরাই কাঠ পাচার রোধে অভিযান চলছে। তবে পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য তাতে রোধ হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস বলেন, ‘রুলে বলা আছে-ব্যক্তি মালিকানাধীন কাঠ ও বনজাত দ্রব্য পরিবহনের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার নিকট ‘ক’ ফরমের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে।’

তিনি অঅরও বলেন, ‘ট্রানজিট রুল ১৯৭৩ বলা আছে, বনজাত পণ্য পরিবহনে সন্দেহ হলে বনবিভাগের কর্মকর্তারা পরীক্ষণ ফাঁড়িতে তল্লাশি বা পরীক্ষা করবেন। বন বিভাগ কাঠ পাচার রোধে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যদিও কাঠ পাচারে চোরাই কাঠ ব্যবসায়ীরা সক্রিয় থাকে সব সময়। তবুও ঝূঁকি নিয়ে কাজ করছে বনবিভাগ।’

(জেজে/এএস/জুলাই ১৭, ২০২৩)


পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test