E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হরি চাঁদ ও মতুয়া সম্প্রদায়ের ওড়াকান্দি মহাবারুনী, লাখো ভক্তে মুখরিত ওড়াকান্দি পূর্ণ স্নান

২০২৪ এপ্রিল ০৬ ১৩:৫৯:০১
হরি চাঁদ ও মতুয়া সম্প্রদায়ের ওড়াকান্দি মহাবারুনী, লাখো ভক্তে মুখরিত ওড়াকান্দি পূর্ণ স্নান

প্রসেনজিৎ বিশ্বাস, ফরিদপুর : শনিবার মতুয়া সম্প্রদায়ের পূর্ণব্রহ্ম পূর্ণাঅবতার হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১৩ তম আবির্ভাব তিথি। প্রায় ২১৩ বছর আগে ওড়াকান্দির নিকটবর্তী সাফলা ডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হরিচাঁদ ঠাকুর। বর্তমানে শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি মতুয়া ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস।

বাস্তবিক, দলিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের ত্রাণকর্তা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হরিচাঁদ ঠাকুরের কৃতিত্ব বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বৈষ্ণবভক্ত যশোবন্ত ঠাকুর ও অন্নপূর্ণা দেবীর সন্তান হরিচাঁদ জন্মেছিলেন বিশেষ মাহেন্দ্রক্ষণে। অনেকেই তাঁকে গৌতম বুদ্ধ ও চৈতন্যদেবের অবতার হিসেবে মনে করেন। সাদামাঠা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হরিচাঁদ।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সুযোগ পাননি, ভরসা করতে হয়েছে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার পর্যায়ক্রমে। হিন্দু, বৌদ্ধশাস্ত্র, দেশীয় চিকিৎসা, ভূমি ব্যবস্থাসহ একাধিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। অবতার পুরুষ হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ হয় এবং অচিরেই তার ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে।

হরিভক্তদের মতুয়া বলার প্রচলন হয় এবং ওড়াকান্দি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই ওড়াকান্দি বর্তমানে তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে যেখানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় প্রতি বছর শ্রীমৎ স্বামী তারক চন্দ্র সরকার লিখিত শ্রীশ্রী হরি লীলামৃত সমস্ত গ্রন্থে নির্যাস হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

মতুয়া সম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তার অন্যতম একটি কারণ ছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের দর্শন। পতিতজনের মুক্তির পন্থা দান ছিল অন্যতম লক্ষ্য। প্রচলিত ধর্ম শাসন পদ্ধতির সমালোচনা করে তার বক্তব্য ছিল যে বাহুল্য-সর্বস্ব ধর্মচর্চা সাড়। হাতে নাম মুখে কাজ এই মূলমন্ত্র সঙ্গী করে তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির আশু উন্নতির জন্য সচেষ্ট ছিলেন জীবনভর।

সকলের মধ্যে ঐক্য সুষ্টির জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে জীবন সায়নের পূর্বে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে গিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে। পরবর্তীকালে, পিতার দেখানো পথেই গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজের অবহেলিতদের একত্র করেছিলেন। তবে একথা না বললেই নয়, হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তার পুত্র দুজনেই শুধুমাত্র হিন্দু সমাজের নমঃশূদ্রদের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তেলি, মালি, মাহিষ্যসহ সকল সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করে গেছেন। মতুয়া ভাবাদর্শ প্রচারের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। দলিত সমাজের মানুষ হয়ে নিজের পিতার স্বপ্নপূরণ করে বর্ণহিন্দুদের জন্য ১৮৮০ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর ওড়াকান্দিতে প্রথম স্কুল স্থাপন করেন এবং ১৯০৮ সালে সরকারি সহায়তায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে রূপান্তরিত হয় সেটি। বর্তমানে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন যা ধর্ম, কর্ম, জ্ঞান প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। নিজের সময়ে বর্ণহিন্দু তথা নমঃশূদ্র মানুষদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দেখে যেতে পারেননি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর।

শনিবার ভোর ৫ টা ২৮ মিনিটে শ্রীধাম ওড়াকান্দির গদিনসীন ঠাকুর ও মেলা উদযাপন পরিষদের সভাপতির নেতৃত্বে ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা প্রথমে বারুনী সাগরে ও পরে কামনা সাগরে স্নান করে এ স্নানোৎসবের শুভ সূচনা করেন।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসহ দূর দূরান্তের কমপক্ষে ২ ডজন জেলা বরিশাল, ভোলা,ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালি, বরগুনা, যশোর, নড়াইল, কুমিল্লা, চাঁদপুর,বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা প্রভৃতি জেলা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ নানা প্রান্ত থেকে পায়ে হেটে, বাসে চড়ে, ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে লাল নিশান উড়িয়ে আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সকলেই হরিবোল হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ প্রকম্পিত করে মিছিল সহকারে মতুয়া ভক্তরা ওড়াকান্দির হরি মন্দিরের সামনে হাজির হন।

ওড়াকান্দির স্নানোৎসবকে ঘিরে ৫ দিনের বারুনীর এ মেলায় ধর্মীয় আবহ যেমন তেমনি রয়েছে লোকজ ঐতিহ্য। গোপালগঞ্জের এ মেলা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এলাকার সবশ্রেণির মানুষের সর্বজনীন এ মেলা। মেলায় লোকজ ঐতিহ্য বেত, বাঁশ, ব্রোঞ্জ, মৃৎ, কুটির শিল্পজাত সহ নানা দ্রব্য সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে।

স্নানোৎসবে ভক্তদের স্নানের জন্য কামনা সাগর ও শান্তি সাগর নামে দুটি পুকুর রয়েছে।শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে ছোটবড় ৫ টি মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে হরিচাঁদ মন্দির ও গুরু চাঁদ মন্দির প্রধান । অপর ৩ টি হচ্ছে চন্ডি মন্দির।

কাশিয়ানী উপজেলা চেয়ারম্যান ও হরিচাঁদ ঠাকুরের ৬ষ্ঠ পুরুষ সুব্রত ঠাকুর হিল্টু বলেন, এ স্নানোৎসবে অন্তত ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে। স্নানোৎসব সফল করতে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হযেছে। সুব্রত ঠাকুর আরো জানান, প্রায় পৌনে ২শ’ বছর আগে ওড়াকান্দিতে স্নানোৎসব ও বারুনীমেলার প্রচলন হয়। তারপর থেকে এ উৎসব চলে আসছে।

কাশিয়ানী থানার ওসি মোঃ জিল্লুর রহমান বলেন, স্নানোৎসবে পুলিশ সদস্যসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছে।

(পিবি/এএস/এপ্রিল ০৬, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test